জুয়েল রাজ।। লন্ডনে ‘দোঁহে’ শিরোনামে আবৃত্তিসন্ধ্যায় মুগ্ধতা ছড়ালেন বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীন ও শহীদুল ইসলাম সাগর। রোববার তাদের অনবদ্য উপস্থাপনায় কবিতাপ্রেমিরা যেনও আস্বাদন করলেন কাব্যসাহিত্যের প্রকৃত রস। প্রেম-দ্রোহ আর দেশাত্ববোধের কবিতায় হলভর্তি দর্শকরা শুধু ছন্দের দোলায়ই আচ্ছাদিত হননি, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে তাঁদের প্রাণ।
পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি সেন্টারে ২২ জুলাই অনুষ্ঠিত এ কাব্যসন্ধ্যাটি ছিলো নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। বিকেল/সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৯টা, পুরো দুইঘন্টাই কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো হল। মুনিরা ও সাগর মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট করে রেখেছিলেন শ্রোতাদের । অনুষ্ঠানে মোট ২২ জন কবির ২৯ টি কবিতা আবৃত্তি করেন তাঁরা। এরমধ্যে পাঁচটি ছিলো যৌথ উপস্থাপনা।
অনেকটা ব্যতিক্রমী পন্থায় শুরু হয় এই আবৃত্তি আয়োজন। জনপ্রিয় টিভি প্রেজেন্টার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আবৃত্তি শিল্পী উর্মি মাজহার প্রথমেই দুই বাচিক শিল্পীর জীবন থেকে পাঠ করে তাদেরকে মঞ্চে আহ্বান করেন। ‘পথ বেধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থী আমরা দু’জন চলতি হাওয়ার পন্থী’ এই কবিতাটি আবৃত্তি করতে করতে মুনিরা পারভীন এবং শহীদুল ইসলাম সাগর মঞ্চে প্রবেশ করলে দর্শকরা তাদেরকে করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানান। ‘ভারা বাদর’- শীর্ষক নেপথ্য সংগীত এক ভিন্ন আবহের সৃষ্টি করে এ সময়। গানটি বাতাসে লীন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌথ আবৃত্তি উপস্থাপনার সূচনা করেন মুনিরা। ‘একবার একজন আমাকে অপমান করেছিলো/ আমি তাকে রাজপুটিন উপহার দিয়েছিলাম’/একবার একজন আমাকে বেঁধে রেখেছিলো/আমি তাকে যিশুর গল্প শুনিয়েছিলাম /
একবার একজন আমাকে মারার চক্রান্ত এঁটেছিল/আমি তাকে চক্রান্তের খরচ যুগিয়েছিলাম/
একবার একজন আমার হাতে হাত রেখে অগ্নিদগ্ধ হতে চেয়েছিল/
আমি ভীতু কাপুরুষ কিছুই পারিনি দিতে/
আজ /এই কবিতা সন্ধা/ তাকেই দিলাম।
দুজনে কবিতাটি আবৃত্তির পর একে একে টানা ১শ ২০ মিটির বাংলা কাব্যসাহিত্যের রথি মহারথিদের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন মুনিরা-সাগর। দর্শকদের মুহুমুহু করতালি আবেগঘন এই আবৃত্তি সন্ধ্যাকে উপভোগ্য করে তুলেছিলো। সব শেষে মুনিরা যখন অপূর্ব শর্মার বীরাংগনা থেকে সন্ধ্যা রানীর ৭১ এর দুঃসহ দিনের কথা পাঠ করছিলেন, সেই পাঠ দর্শকদের আলোড়িত করে তুলে। সন্ধারানীর পাঠের পর পরই সাগর আবৃত্তি করেন শামাসুর রহমানের অভিশাপ দিচ্ছিকবিতা। এযেন আমাদের আজন্ম অভিশাপের ক্রোধ আর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।
জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী শওমী দাসের কোরিওগ্রাফি এবং শতরূপা চৌধুরীর আবহ সংগীত অনুষ্ঠানে যুক্ত করে ভিন্নমাত্রা। পুরো অনুষ্ঠানের সংগীত আয়োজনে ছিলেন প্রীতম সাহা আর প্রজেক্ট ব্যবস্থাপনায় মোস্তফা জামান নিপুণ। আলোকসজ্জ্বায় ছিলেন মিঠু আজাদ এবং সাউন্ডে পাপ্পু।
আবৃত্তি শেষে মূল্যায়ন পর্বে অংশ নেন জাতিসংঘের ইউএনডিপিতে কর্মরত মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড. সেলিম জাহান, কবি ও লেখক শামীম আজাদ, সাংবাদিক আব্দুস সাত্তার, মুহাম্মদ জুবায়ের, ফারহান মাসুদ খান, বুলবুল হাসান, ফারুক আহমদ রনি, জাকি রেওয়ানা আনোয়ার, সৈয়দ আফসার উদ্দিন মিঠু, ক্রাউন সিমেন্টের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, মুনিরা পারভীনের মেয়ে আফরা রহমান খন্দকার এবং শহীদুল ইসলাম সাগরের স্ত্রী মেহেরুন নেসা।
বক্তারা দর্শনীর বিনিময়ে এই আয়োজনকে সাহসী পদক্ষেপ আখ্যায়িত করে বলেন, এর মাধ্যমে ইতিহাস তৈরি করলেন মুনিরা-সাগর। বিলেতে সুংস্থ বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে তাদের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। অনুষ্ঠানটি আমাদেরকেও দায়বদ্ধ করলো। বক্তারা আগামীতেও এ ধরনের আয়োজন করার জন্য উদ্যোক্তাদের অনুরোধ জানান।
মুনিরা পারভীন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আবৃত্তি সন্ধ্যা ‘দোঁহে ‘ সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে আরও একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো আমার। দর্শনীর বিনিময়ে লন্ডনে আবৃত্তি অনুষ্ঠান আয়োজনের যে অভিপ্সা দীর্ঘদিন ধরে লালন করছিলাম মনে, সেটিই রোববার স্বার্থকতা পেলো ব্রাডি সেন্টারে। কাব্যানুরাগিরা ঠিক যেভাবে প্রেরণা যুগিয়েছেন অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তা মনে থাকবে চিরকাল।
শহীদুল ইসলাম সাগরে বক্তব্যেও উঠে আসে আশাবাদের কথা। তিনি বলে, আমি অভিভূত। দর্শক শ্রোতাদের বিপুল উপস্থিতি আগামীতে এ ধরনের আয়োজনে আমাদের সাহস যোগাবে মনে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাকে প্রবহমান রাখতে এই আয়োজনের মতো ভবিষ্যতেও সহলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।