আতাউর রহমান মিলাদ কবিতার এক স্বাধীন স্বত্বা

আতাউর রহমান মিলাদ কবিতার এক স্বাধীন স্বত্বা যদিও আবহমান বাংলা কবিতার ধারাবাহিতার বাইরের কেউ তিনি নন।

তবু কবিতার একটা বাঁক তার লেখায় স্পষ্ট।

ভিন্ন একটা ছাপ, ভিন্ন একটা পথের আভাস তিনি দিতে পেরেছেন।তার কবিতা পাঠে মনে যে অনুরণন অনুভূত হয়, যে সৌকুমার্যে তিনি কবিতা উপস্থাপন করেন তা আমাদের ছুঁয়ে যায়।কবিতার তার সাথে যদি পাঠক একাত্ম বোধ করে তবে সে কবিতাকে এবং কবিকে সার্থক ধরে নেয়া যায়।কবি আতাউর রহমান মিলাদের কবিতা প্রায় সব পাঠকই আত্মস্থ করতে পারে বলে আমাদের ধারণা।সহজ এবং আটপৌরে শব্দে সরল বাক্যে কবিতার দোলায়িত ছন্দে কবিতা পাঠ একটা ভিন্ন আমেজের সৃষ্টি করে, জীবনের জটিলতার বিপরীতে একটা পেলব বিকেল কবিতানন্দে কাটাতে পারলে জীবনের সার্থকতা অনেকাংশে পরিস্ফুট হয়।

কবি মিলাদের কবিতা আমাদের তাই দিতে সক্ষম, তার সুলিখিত একটি কবিতা কর্মক্লান্ত দিনের শেষে কিছুটা স্বস্তি এনে দিতে পারে।কবিতাও জীবনের অংশ, জীবন কবিতাময় হলে আখেরে জীবনেরই লাভ… প্রিয় পাঠক আসুন কিছুক্ষণ মিলাদময়, কবিতাময় কাটাই…

আতাউর রহমান মিলাদ এর আটটি কবিতা

রাতের প্রতিকৃতি
রাতের নীরবতা ভেঙে জেগে উঠে যে জীবন
বিভ্রান্তির অন্ধকারে আমরা চিনি না তাকে
আঁধারে সন্দেহ থাকে
ঘাপটি মারা ভয়
কে আসে কে যায়, জানা হয় না পরিচয়।

থেমে যায় মুখরতা, অস্তিত্বের জলোচ্ছ্বাস
নিদ্রাহীন জোসনায় তারাভরা হাহাকার
মুখঢাকা করতলে
পিছলে পরা ভুল
অসফল ভ্রমণ শেষে সম্ভ্রম হারানো ত্রিকুল।
রাতভর,
অস্থির বিশ্বাস বাড়ায় কষ্টপ্রহর।

হলুদ পুতুল
আমি প্রতিদিন অসামাজিক হই
দূরে যাই ছুঁড়ে যাই ভ্রান্তিবিলাস
পুড়ে ফেলি নাগরিক ভুল।

এক জীবনের ক্রীতদাস উৎসবে
দারুচিনি গল্পের মগ্নব্যাকুলতায়
কুড়িয়ে যাই হলুদ পুতুল।

প্রতিদিন জীবনের নেপথ্য সঙ্গীত
প্রার্থনায় আড়াল করে শিল্পভ্রমণ
পালকের ছায়া পড়ে দ্রাবিড় বুকে
আত্মকলহ ভোরে ক্রমাগত স্বপ্নক্ষরণ।

ছদ্মবেশী ডানার আওয়াজ
দোকানে দোকানে তারিয়া ভর্তি আলো
ভুল করে বারবার
অন্ধকার কিনি,
পথ পেরুলেই অন্তহীন পথের শুরু
নিজেকে নিজে আর
কতটুকু চিনি।

দুই কাল কেটেছে স্মৃতির করাত
এক কালে আছি
পলায়নে বেঁচে,
বণিকেরা খেয়ে যায় পথের আলো
দ্বিধাহীন দিন কাটে
মৌমাছি নেচে।

চলমান ঢেউ খুঁজে তীরের সন্ধান
কখন যে মিশে যায়
দুর্বল স্রোতে,
জলে স্থলে এতোবেশী ছদ্মবেশী চাল
পারি না উড়িয়ে দিতে
দীর্ঘ এক ফুঁতে।

কালপর্ব
সময়ের ডাক শুনে যারা জেগে না ওঠে
তারা আদপে মৃত অথবা অচেতন
যোগ বিয়োগের দেয়ালে কালে কালে
ঝুলে থাকে কিছু অসম্পূর্ণ মানুষের ছবি

সময় এসেছে শত্রুকে শত্রু বলার
পরের স্বপ্ন রোদে মেলে যারা
পুড়ছে নিজের হাত
তারা চিহ্নিত হোক সময়ের পোড়াদাগে
জলের গভীরে জাল ফেলে যারা
শিকার করছে মাছের উৎসব
ছোট ছোট অকৃত্রিম ঢেউ
পড়শি ভোরে আজ
জেনে নেই কাছে ও দূরের সকল নিশানা

দৃশ্যমান পথের নকশা
নকশীকরা আলোর বিন্যাস ছিঁড়ে
শুধু মেপে নেয়া সময়ের গতি ও প্রকৃতি

আড়ালের ভাষা
শুনতে না পেলে ও আড়ালে কিছু কথা ভাসে
হাওয়ার কানে শিস দিয়ে যায় পাতার বাঁশি
গোপন দরোজায় কেউ বসায় সতর্ক পাহারা

কানে ভাসা কথামালা শোভন সন্ধ্যায়
ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় বিমূর্ত জখম
শীতের দুয়ারে গলে পড়ে হিমপ্রবাহ
লেপের উষ্ণতায় উদ্ধার করি শীতের ভাষা

কোন পাখি উড়ে গেলে পাতাদের ফাঁকে
বনেরা ধরে রাখে পাখার আওয়াজ
দৃশ্যপট ফাঁকি দিয়ে রাতেরা গাঢ় হলে
আড়ালের ভাষা করে ভুল অনুবাদ

শুনতে না পেলেও আড়ালে কিছু কথা ভাসে
শব্দহীন বিশ্বাস ঘুরে নিঃশব্দ কম্পাসে

মোড়ক
আমি ও মিতা দাবার ঘরে বাস করি
দাবার চালে কেউ কাউকে মাত করি
দাবার ঘোড়া আড়াইঘরের বাইরে রেখে
সময়টাকে ভাগ করি
নির্জনতার বারান্দাতে নির্মমতা গ্রাস করি
চিন্তা এবং চিত্রকল্প মগ্নভোরে ফেরি করি

আমি ও মিতা দাবার ঘরে বাস করি
মধ্যবিত্ত স্বপ্নগুলো গ্লাস ভরে পান করি
স্বল্প আয়ের স্বপ্নভেঙে
জীবনটাকে নাশ করি
ভিন্নরকম মুখোশ এঁটে বেঁচে থাকার ভান করি
উড়ার মোহে আকাশটাকে সঙ্গী করি

আমি ও মিতা দাবার ঘরে বাস করি
খাঁচার ভেতর তিন পুরুষের চাষ করি
এক পলকে জীবন থেকে
আশি নাম্বার বিয়োগ করি
ছায়া এবং হাড়ের গুঁড়ো জমা করি

উপসংহার
এই জীবনে এমনি করে বেঁচে থাকার ইচ্ছে করি।

পেছনে গল্প ছিলো সামনে মায়া
যে আমাকে ডেকেছিল ধূসর সন্ধ্যায়
স্মৃতিচিত্র নিয়ে তার মধ্যরাত কাঁদে
জানালার পাশে জাগে বেআব্রু চাঁদ
ভেতরে প্রেমিক মন ক্লান্ত অবসাদে।

পেছনে গল্প ছিলো সামনে মায়া
ছায়ায় মিশে যাওয়া স্মৃতিমুখ
অন্ধকারে দ্বিধাগ্রস্ত প্রাণের কাঁপন
স্বপ্নের ঘাইমারা তন্দ্রা অসুখ।

জীবন কঠিন সময়টা বড় ফাঁকা
অষ্টপ্রহর মনে বাজে না রুমুঝুমু
পথের চিহ্ন ভুলে ছায়া স্মৃতি
আমার গালে আঁকে না সন্ধ্যাচুমু।

যে আমাকে ডেকেছিল ধূসর সন্ধ্যায়
জেগে থাকে সে আজো মোহমুগ্ধতায়।

বরফজমা ধূম
লাশঘরে কাটা হোক জীবন আমার
দুঃখটা তোমার কাছেই রেখো
এই যে সময়ের হাতপাখা
বাতাসে তুলছে ঢেউ
সেও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে একদিন।

সবকিছু ছিঁড়ে যায় মায়ার ঘুঙুর
গন্তব্যের সিঁড়িভাঙা ব্যর্থ শপথ
মেঘের পরতে পরতে বৃষ্টির সোহাগ

মলাটের ভেতরে যতোই আড়াল রাখি
রঙিন প্রচ্ছদ, আঙুলে জমা থুথু
ঠিকই ধ্বংস করে মসৃণ পৃষ্ঠা

প্রতিদিন ডুব-সাঁতার, বহুবর্ণ ঘুম
ঘরে ও বাহিরে আজ বরফজমা ধূম

  কৃতজ্ঞতা:কবি-প্রাবন্ধিক আবু মকসুদ

ACB#17

Advertisement