আমরা কি ঠিক রাস্তায় আছি?

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে চিরন্তন রূপ দেওয়ার দৌড়ঝাঁপের নতুন মই বা সিঁড়ির নাম এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)। এর আগে আমাদের দৌড়াতে বলা হয়েছিল নতুন শতাব্দীর উপযুক্ত হওয়ার জন্য। বেঁধে দেওয়া হয়েছিল কতিপয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। সে লক্ষ্য অর্জনের দৌড়ের নাম ছিল সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি)। এমডিজির নানা অর্জনের ছক কষতে আর ছক অনুযায়ী সিদ্ধিলাভের জন্য মুরব্বিদের তহবিলও ছিল। সে দৌড়ে আমরা খারাপ করিনি। পুরস্কার-স্বীকৃতি-সংবর্ধনা-ট্রফি সবই শ্রেণিমতো পেয়েছিলাম। বাল্যবিবাহের বদনাম ঘোচানোর জন্য আমরা মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে দিয়ে রেটিং অর্জনে কামিয়াব হওয়ার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছি। চলছিল সব ঠিকমতো।

গোল বেধেছে এসডিজি নিয়ে। সময়মতো অর্জন করতে হবে, কিন্তু তহবিল যার যার তার তার। টেকসই উন্নয়নের তেল নিজের কড়ি দিয়েই মাখতে হবে। ফেলো কড়ি মাখো তেল। দফায় দফায় ব্যাংক লুট করে টাকা পাচারে আমাদের রেকর্ড থাকলেও কাজের সময় তহবিলের ঘাটতি ঘটে সব সময়। উন্নয়ন ও বিকাশকে চিরন্তন বা টেকসই করার আরেক শর্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিক, দুর্নীতিমুক্ত আর জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃশ্যমান উপস্থিতি। আজকাল এসব নিয়ে আমাদের সাড়াশব্দ একেবারেই নেই। ভাঙা বা বসে যাওয়া গলায়ও এসবের গান এখন আর কেউ গায় না।

জাতিসংঘের মহাসচিব আর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রাথমিক সাক্ষাতের পর টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) নিয়ে দিলখুশ আলোচনায় সরাসরি এসব কথা আমাদের বাছাই করা মেধাবী বিবেকদের জানিয়ে দিয়েছেন। আম-আলোচনার আদলে হলেও অতিথিরা ছিলেন খাস, বাছাই করা প্রমুখ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাঘা রাষ্ট্রদূত, উন্নয়ন সহযোগী, চেম্বার অব কমার্সের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও পছন্দের এনজিও প্রতিনিধি, ভাইস চ্যান্সেলর, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, কিশোর-যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট শাক দিয়ে মাছ না ঢেকেই খোলাখুলি জানালেন, গণতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান ছাড়া টেকসই কী, কোনো পুতু পুতু উন্নয়নও সম্ভব নয়। চেহারা ঠিক রেখে হাসিমুখে কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে সমঝিয়ে দেন গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের অপরিহার্যতার কথা। আমাদের নানা রঙের কমিশন দিয়ে কি জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের নেক চাহিদা মিটবে? একজন তো এক সংবিধানিক পদে থেকেই বলে চলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের নাকি কোনো সংজ্ঞা নেই। সংজ্ঞাহীন মানুষের কাছে কোনো সংজ্ঞাই যে সংজ্ঞা নয়, তা কি কাউকে বলে দিতে হবে? তবে বয়ানে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি যে কথিত অবকাঠামোর কথা বলেছেন, তার আসল কার্যকারিতা নির্ভর করছে ওই কাঠামোর তখতে কোন খাসলতের চালক বসছেন। গাড়ির চালক গরু-ছাগল চিনলেই যেমন সনদ পাওয়ার যোগ্য হয়ে যান, এমন নীতি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে কাঠামো কি কিছু করতে পারবে? অবকাঠামোর পাশাপাশি তিনি শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা, নারীর ক্ষমতায়নের কথাও বলতে ভুল করেননি। এসব খাতে বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করলেও হালের পড়তি মানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু এসব করতে ম্যালা টাকা লাগবে। চেম্বারের লোকজন কী ভেবেছেন জানি না, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বললেন, প্রাইভেট সেক্টরের খোলাদিল অংশগ্রহণ না থাকলে চলবে না। তাঁর মতে, এসডিজির প্রায় ৪০ শতাংশ আসতে হবে প্রাইভেট সেক্টর থেকে। তিনি হিসাব দেন, এসডিজি অর্জন করতে হলে প্রতিবছর কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার লাগবে অথচ প্রতিবছর পাওয়া যাচ্ছে কয়েক শ বিলিয়ন মাত্র। প্রয়োজন ও প্রাপ্যতার ফাঁকটুকু পূরণ করতে হলে জাপান, ইউরোপ আর পশ্চিমের নানা দেশে যে অলস টাকা পড়ে আছে, যেখানে টাকা রাখার জন্য উল্টো ব্যাংককেই টাকা দিতে হয়, সেখান থেকে বিনিয়োগের সংস্থানের জন্য উদ্ভাবনী উপায় খোঁজার আহ্বান জানান তিনি। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকও কাজ করছে বলে তিনি আশ্বস্ত করলেও কাজটা আদতে আমাদেরই করতে হবে। তেমন মেধাবী আমলা কোথায়? কোটার খপ্পরে মেধার প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। জলবায়ু তহবিলের হিস্যা আনার কাগজ তৈরির জন্য লাগছে বিদেশি কনসালট্যান্ট।

জাতিসংঘের মহাসচিব বয়সে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের চেয়ে বড়। আলোচনার কঠিন সুরটা বেঁধে দিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তাঁর কাজটা সহজ করে দিয়েছিলেন। প্রবীণ মহাসচিবও চমৎকার বক্তা। প্রশংসা দিয়ে বাজিমাতে তিনিও উস্তাদ। জানান, বাংলাদেশের জন্য তিনি তিনটি শব্দ ব্যবহার করবেন: সংহতি, প্রশংসা আর উদ্বেগ। মিয়ানমারের নাগরিক আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবতার প্রতি যে সংহতি দেখিয়েছে, আজ পুরো পৃথিবী বাংলাদেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে। উনারাও এসেছেন এই সংহতি প্রকাশেরই অংশ হিসেবে। পৃথিবীতে সংহতির এর চেয়ে ভালো কোনো উদাহরণ আছে কি না তাঁর জানা নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের দক্ষতা, দুর্যোগ সহিষ্ণুতায় অগ্রগতি, বাংলাদেশের উন্নয়ন, বিশেষ করে মানব উন্নয়নে বাংলাদেশ যা করে দেখিয়েছে, সেসবের জন্য তাঁর প্রাণঢালা প্রশংসা। তাঁর উদ্বেগের মূল কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন, যা আমাদের সব অর্জনকে ধুয়ে দিতে পারে। সেই সঙ্গে তিনি উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে তরুণদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেন। আরব বসন্ত এবং তার পরের ঘটনাবলি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, যে তারুণ্য সামাজিক পরিবর্তনের মূল শক্তি, সেই তারুণ্যকেই যথাযথ কাজে না লাগালে তা হয়ে যেতে পারে নিরাপত্তা-ঝুঁকি। তরুণদের নিয়ে, তরুণদের দিয়ে উন্নয়নই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জকে শক্তিতে রূপায়ণ করতে পারে। সে শক্তি হবে টেকসই শক্তি। এই প্রবীণ যেন নজরুলের সুরে তারুণ্যের জয়গান গাইলেন।

তাঁদের দুজনের দেড় ঘণ্টার বক্তৃতায় চিন্তার অনেক খোরাক ছিল। মুগ্ধতার আবেশ কাটিয়ে ভাবতে হবে, আমরা কি তরুণদের সঠিক পথে চালিত করছি? গত দুই দিনের ফ্লাইং কিক আর ভিন্নমতের তরুণদের অন্য তরুণদের লেলিয়ে দিয়ে গণপিটুনির ছবি কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে? আমরা কি ঠিক রাস্তায় আছি মাননীয় জাতিসংঘের মহাসচিব, প্রেসিডেন্ট বিশ্বব্যাংক?

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Advertisement