‘মেইলা-মেইলি নয়, মেশামেশি করুন’

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ‘এই যে সারা দিন ইন্টারনেটে থাকো। একটু ঘুরতেও যেতে পারো। কদিন আগেই আমি এক চমৎকার ইকো রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে এসেছি।’

ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের আসক্তিসংক্রান্ত আমার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে ওপরের কথাগুলো লিখেছেন বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের যুগ্ম সম্পাদক ও তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী এনায়েত হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো এবং সারা দেশে গণিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান কংগ্রেস এবং ক্রাউন সিমেন্ট-প্রথম আলো তারুণ্যের জয়োৎসব সংগঠিত করতে গিয়ে আমাকে বিপুলসংখ্যক কিশোর-তরুণের সংস্পর্শে আসতে হয়। টের পাচ্ছি, কেমন করে তাদের আকাশটা দখল করে নিচ্ছে ৩-৪-৬ ইঞ্চির জ্বলজ্বলে পর্দা।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাই, দিনে কয় ঘণ্টা তারা ফেসবুকে কাটায়? এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা—এভাবে জিজ্ঞাসার একপর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী বলে, ‘আমরা স্যার কখনো লগআউটই করি না। আমাদের ফোনে সারাক্ষণই ফেসবুক ও মেসেঞ্জার লগইন
করা থাকে।’

পড়ানোর সুবাদে আমি দেখেছি, একদল শিক্ষার্থী এখন আর খাতা-কলম নিয়ে ক্যাম্পাসে আসে না। ওদের ভরসা এখন শিক্ষকের দেওয়া পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের কপি (কাগজের কপি নয়, কম্পিউটার ফাইল)। যেসব শিক্ষক পাওয়ার পয়েন্টের পরিবর্তে বোর্ডে লেখেন, তাঁদের বোর্ডের ছবি তুলে নেওয়া হয় মুঠোফোনে।

কারণ খুবই সহজ। ও যখন ক্লাসে থাকে, তখন ওর অন্য কোনো বন্ধু হয়তো কোথাও খেতে গেছে। সেখানে গিয়ে ‘চেকইন’ দিয়েছে, ছবি দিয়েছে কিংবা কোনো মেসেজ দিয়েছে। ওর তখন ‘দায়িত্ব’ হয়ে পড়ে সেখানে লাইক, কমেন্ট করা বা মেসেজের জবাব দেওয়া। ফলে ক্লাসে মনোযোগ দেওয়াটা ওর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য হয় অ্যাসাইনমেন্ট, হোমওয়ার্কের বেলায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দলের একজন কাজটা করে বাকিরা কপি পেস্ট করে চালিয়ে দেয়। কারণ, তাদের অনেক ‘ব্যস্ততা’। ফেসবুকে লাইক দিতে হয়, কমেন্ট করতে হয়, চেকইন দিতে হয়, বন্ধুর কোনো কিছু শেয়ার দিতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এ পড়ুয়ারা মিলেনিয়াম প্রজন্ম বা ওয়াই প্রজন্মের (যাদের জন্ম ১৯৮১-২০০৫ সালের মধ্যে) শেষ দিককার সদস্য। ওদের বেড়ে ওঠার একটা বড় সময়জুড়ে তারা ইন্টারনেটের বিকাশ আর তার প্রত্যক্ষ সুফল আর কুফল দেখছে। ফলে তারা যন্ত্র ব্যবহারের চেয়ে যন্ত্রের দাস হয়ে পড়ছে বেশি মাত্রায়। এই প্রজন্মের শুরুর দিকের প্রতিনিধিরা এখন মা-বাবা হতে শুরু করেছেন। তাঁদের সন্তানসন্ততি হলো ‘ডিজিটাল নেটিভ’। ফলাফল কেমন হচ্ছে?

যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি মিলেনিয়াম মা-বাবা ও তাঁদের ডিজিটাল ছেলেমেয়েদের লক্ষ করি। গেল ঈদে দেখলাম যখনই কোনো ছোট বাচ্চা কান্নাকাটি করে, তখনই তার বাবা বা মা তাকে একটা স্মার্টফোন ধরিয়ে কোথাও বসিয়ে দিচ্ছে। মিলেনিয়াম বাচ্চাদের টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনচিত্র দেখিয়ে খাওয়ানোর যে ভুল রীতিটি আমরা সামলাতে পারিনি, সেটি এখন আরও বিকশিত হয়েছে। শুধু পর্দা হয়ে গেছে ছোট আর টিভি চ্যানেলের জায়গা দখল করেছে ইউটিউবের চ্যানেল।

কাজটা কি ভালো হচ্ছে? আমার জন্য এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। কাজের কারণে আমি এমনকি নিজেও প্রচুর সময় ইন্টারনেট আর ফেসবুকে কাটাই। তবে আমি লক্ষ করছি যে সিলিকন ভ্যালি, যেখানে এই নতুন প্রযুক্তির বিকাশ হচ্ছে, সেখানকার মা–বাবারা কেমন।

২০১৮ সালের শুরুতে জো ক্লিমেন্ট ও ম্যাট মাইলস নামের দুজন শিক্ষক এ নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। সেই বইয়ে তাঁরা যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো হয়তো আমাদের ভিন্নভাবে ভাবতে সাহায্য করতে পারে। স্ক্রিন স্কুলড নামের বইয়ে তাঁরা প্রযুক্তিজগতের দুই বিখ্যাত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবসের কথা বলেছেন।

বিল গেটস তাঁর সন্তানদের হাতে ১৪ বছরের আগে স্মার্টফোন দেননি। স্টিভ জবস এমনকি তাঁর সন্তানের হাতে দেননি আইপড! কারণ, অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখকদ্বয় বলছেন, সিলিকন ভ্যালির এসব মা-বাবা তাঁদের উদ্ভাবিত গ্যাজেটের সম্মোহনী শক্তি সম্পর্কে অন্যান্য মা-বাবার চেয়ে বেশি জানেন। জানেন বলেই তাঁরা তাঁদের সন্তানদের মানসিক বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত তাদের হাতে এই ‘বিপজ্জনক’ গ্যাজেট তুলে দিচ্ছেন না।

বিপজ্জনক কেন বলছি? কারণ, আমেরিকার গবেষকেরা বলছেন, অষ্টম শ্রেণির যেসব শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোরাফেরা করে, তাদের মধ্যে হতাশার হার অন্যদের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি। দিনে তিন ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে গেছে অনেকখানি! এখনকার মা–বাবারা বাড়িতে ফিরে মুঠোফোন বা কম্পিউটারে ব্যস্ত হয়ে যান। নিজেদের সময় নিরঙ্কুশ করতে তাঁরা সন্তানদের ব্যস্ত রাখেন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট দিয়ে। অথচ শিশুর বিকাশ নিয়ে কাজ করেন, এমন বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে বাসায় বেশি হইচই হয়, সেখানেই তিন বছরের কম বয়সীরা সবচেয়ে বেশি শব্দ শেখে!

আমেরিকার মতো দেশে এখনো ছেলেমেয়েদের গড় বয়স কমপক্ষে ১০ বছর না হলে তাদের ফোন দেওয়া হয় না। ক্লিমেন্ট ও মাইলস তাঁদের বইয়ে সিলিকন ভ্যালির বেশ কয়েকটি স্কুলের কথা বলেছেন। এমন একটা স্কুলের নাম ওয়ালড্রফ স্কুল। সেখানে এখনো শিক্ষকেরা ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখেন এবং শিক্ষার্থীরা ২ নম্বর পেনসিল ব্যবহার করে। তাদের শিক্ষার বড় অংশজুড়ে থাকে পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা শেখানোর পদ্ধতি। এমআইটির ‘প্রত্যেক শিশুর জন্য ল্যাপটপ (ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড)’ প্রকল্পের শিক্ষাও আমাদের বিবেচনা করা উচিত। বেশির ভাগ জায়গাতেই এ প্রকল্প মোটেই সফল হয়নি।

প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে সর্বত্র। কারণ, সেটাই সত্য এবং সেটাই বাস্তব। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন আমাদের মৌলিক গুণাবলি ও বেড়ে ওঠার সৌন্দর্য, আনন্দ কিংবা ভালোবাসাকে দখল করে না ফেলে। ফেসবুক, ই-মেইল এখন জীবনের অংশ। ব্যক্তি ও কর্মজীবনে এদের অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তার ব্যবহারের বাড়াবাড়ি কাম্য নয়। আমাদের সহকর্মী লাজ্জাত এনাব মহছি প্রায়ই সবাইকে কথাটি মনে করিয়ে দেন। তাঁর উক্তিটিই আমার আজকের লেখার শিরোনাম। যন্ত্রের ওপর মানুষের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এ যুগে এর চেয়ে ভালো কোনো হিতোপদেশ আমার জানা নেই।

Advertisement