সাংবাদিকতা যার পেশা ও নেশা, কিন্ত সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি গল্পকার ৷
শব্দের কাব্যিকতা,ব্যবহার শৈল্পিক উপস্থাপনএবং নান্দনিকতা একেক টি গল্প রূপ পায় জীবন্ত গল্পে ৷
অনেকে বলেন,শব্দের বা ভাবের কারিগর।
বিলেতের এই যান্ত্রিক জীবনে যিনি মানুষ পরিবার সহ দুঃখ বেদনা,হাসি কান্নার,ঘটনাকে কলম ও মেধার বৈচিত্রতা দিয়ে পঠ রচনা করেন,তিনি হলেন সাংবাদিক গল্পকার প্রাচীনতম সাপ্তাহিক জনমতের নির্বাহী সম্পাদক সাইম চৌধুরী৷ব্রিট বাংলার পাঠকের আহবানে বিলেতের গল্প নিয়ে ৷
——————————————————————-
বিলেত জীবন
সাঈম চৌধুরী
বাংলাদেশ থেকে বিদেশের দূরত্ব কতটুকু জানেন?
সাত সমুদ্র তেরো নদী। সেই আদিকাল থেকে বাঙালির কাছে বিদেশ মানেই সাত সমুদ্র দূরের পথ।
সঙ্গে আছে আরো তের নদীর ব্যবধান। মানচিত্র যাই বলুক, মুখে মুখে টানা হিসেবে সমুদ্র আর নদীর সংখ্যায় হেরফের হয় না কখনো। বাঙালিরা বিলেত আসেন কিংবা আমেরিকা, অথবা হুনুলুলু।
বলেন, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসেছি। এমনকি তাদের স্বপ্নের রাজকন্যাও বাস করে এই সমান দূরত্বে। তারা গান করেন, আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে সাত সাগর আর তেরো নদীর পাড়ে…।
দেশ থেকে বিদেশের ব্যবধান টানতে কে, কবে আর কখন সাত সমুদ্র তেরো নদীর হিসাব কষেছেন তার নাম-পরিচয়, গোত্র কারো জানা নেই। তবে নিঃসন্দেহে এই সংখ্যাতত্ত্বের জনক ছিলেন অতি বুদ্ধিমান।তিনি সংখ্যা নিয়ে চমৎকার একটা খেলা খেলেছেন। মাত্র দুই সংখ্যাতেই বিদেশ যাত্রার পুরোটা গল্প বলে দিয়েছেন। সাত এবং তেরো। সাত হচ্ছে সৌভাগ্যের এবং তেরো দুর্ভাগ্যের প্রতীক। দেশ ছেড়ে বিদেশ আসতে হলে এই দুইটি সংখ্যা পাড়ি দিতে হবে। সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্যকে একত্রে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়তে হবে অজানা এক রাষ্ট্রের সন্ধানে।
তবে সংখ্যাতত্ত্বে যতোই সাংকেতিক সর্তকবার্তা থাকুক না কেনো বিদেশ সম্পর্কে বাঙালিদের ধারণা খুবই উচ্চ। আর সেই বিদেশ বলতে যদি বিলেতকে বুঝায় তাহলে তো নাচুনে বুড়ির কানে বাজে ঢোলের বাড়ি। বিলেত যেনো নাস্তানাবুদ পৃথিবীর এক টুকরো স্বর্গ।যেনো বিলেত এলেই মিলবে আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের সন্ধান। সেই চেরাগ ঘষলেই কাড়ি কাড়ি পাউন্ড, রাশি রাশি ভারা ভারা সুখ।
যারা বিলেতের সন্ধান পাননি কিংবা যারা কখনো বিলেত দেখেননি তারা অনেক কিছুতেই বিলেতকে খুঁজে নিতে চেষ্টা করেন। ভালো কিছু দেখলে তার সাথে ‘বিলেত’ শব্দটি যুক্ত করে এক অন্য ধরণের তৃপ্তি লাভ করেন।
যেমন টমেটোকে তারা বলবেন ‘বিলেতি বেগুন’, একটু নাদুস-নুদুস কুকুর দেখলে সেই কুকুরটি হয়ে যায় ‘বিলেতি কুকুর’। সিমেন্টকে তারা বলবেন, ‘বিলেতি মাটি’, যদিও তারা জানেন ছাতকের সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতেই প্রস্তুত হয়েছে এই সিমেন্ট। কোনো অপরূপা রূপসী নারীকে দেখলে নিশ্চিত বলবেন বিলেতি মেম, এভাবে সুন্দরের উপমায় বিলেত শব্দটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।
এই উপমার মাঝে একটি গোপন বেদনা আছে। একটি না দেখা সুন্দরকে দেখা সুন্দরের মাধ্যমে প্রকাশ।
যদিও বিলেত এসে অনেকের আশাভঙ্গ হয়। বিলেতের বেগুনের চাইতে তখন দেশি বেগুনটাই অনেক বেশি প্রিয় বলে মনে হয়। বিলেতি নাদুস নুদুস কুকুর ভালো লাগে না। দেশের অনাহারি কঙ্কালসার কুকুরটির জন্যও মনটা কেমন কেমন করে উঠে। বিদেশি মেম দেখে আর মন ভরে না। দেশের পাশের বাড়ির শ্যামলা বরণ মেয়ের জন্য হৃদয় উতাল-পাতাল হয়। সে অন্য গল্প। আপাতত ঐ গল্পে যাচ্ছিনে।
বিলেত সম্পর্কে বাঙালিদের এতোটা ভালো ধারণার পেছনে মূলত একটাই কারণ। সেটি অর্থনৈতিক। একটু ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য, আরও একটু ভালো রোজগারের আশায় জায়গা জমি বিক্রি করে, মায়ের হাতের ‘অনন্ত বালা’ (যে বালাটি মা পরম যতনে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন বছরের পর বছর, যে বালায় তার বিয়ের গল্প, যে বালায় তার মৃত স্বামীর শেষ স্মৃতিচিহ্ন বসবাস করে) বিক্রি করে বিলেত আসার বন্দোবস্ত করেছেন অনেকেই। তারা এসেছেন, দেখেছেন, কেঁদেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বিলেতকে ভালোবেসে ফেলেছেন। প্রথম প্রথম বিলেত আসার পর প্রত্যেকেই দেশে ফিরে যাবার একটি তীব্র টান অনুভব করেন। তারা নিকটজনের কাছে ওয়াদা করেন, কোনো রকমে দু’একটা বছর টিকে থেকে কিছু অর্থকড়ি করে দেশে ফিরে যাবো। দেশে ফিরে স্বাধীন ব্যবসা করবো। এই বলাটুকুই সার। তারপর বছরের পর বছর যায়, দেশে আর ফেরা হয় না। ওয়াদাটুকু বেমালুম হাওয়ায় মিলায়। কেনো এমন হয় এই প্রশ্নটির উত্তর জানার জন্য সমাজবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ জ্ঞানেই বলে দেয়, উন্নত আর নিরাপদ জীবনের সন্ধান পেয়ে তারা আর দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে ধরে রাখতে পারেন না। দেশ হয়ে যায় তখন সাত সমুদ্র তেরো নদীর দূরের কোনো পথ। যে পথ ধরে মাঝেমধ্যে ঘুরে আসা যায়, মাঝেমধ্যে স্মৃতিকে তাকে ফিরে পাওয়া যায়, কিন্তু স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়া আর হয় না। সামারের ছুটিতে ছয় সপ্তাহ, ক্রিসমাসে চার। দেশে তখন এই হিসেবের যাত্রা। কয়েক দিন দেশবাসের পর আর ভালো লাগে না। যখন তখন বিদ্যুৎ চলে যায়, রাস্তায় বেরুলে দীর্ঘ যানজট, ধুলোবালি, সন্তানের সর্দিকাশি, ফলে ফরমালিন, খাবারে ভেজাল, হরতাল, ধর্মঘট, জ্বালা-পোড়াও, আন্দোলন একের পর এক ফিরে আসার অজুহাত দীর্ঘ হয়। মা গুড়ের সন্দেশ তৈরি করেন, বাবা বাজার থেকে বড় মাছ কিনে নিয়ে আসেন। মা বলেন, খোকা আর কয়েকটা দিন থেকে যা, বাবা বলেন, দুই সপ্তাহের ছুটি বাড়ানো যায় না? ক্ষেপে যায় ছেলে, তোমরা কি বুঝো, এই দেশে মানুষ থাকে নাকি?
ঝোঁকের মাথায় কথাটা বলে খোকা লজ্জা পায়। বাবার কাছে লজ্জা। মায়ের কাছে লজ্জা। নিজের ছেলেবেলার কাছে লজ্জা, দেশের কাছে লজ্জা। তবুও ফিরে আসতে হয়। জীবন যখন ঐশ্বর্য্যরে সন্ধান পায় তখন অনেক কিছু দেখেও দেখতে নেই। অনেক কিছু বুঝেও বুঝতে নেই।
বিলেত ঐশ্বর্য্যরে সন্ধান দেয় এই কথাটির মাঝে কোনো ভুল নেই। আর এ কারণেই তো বিলেতকে নিয়ে এত জয়জয়াকার। বিলেতের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। আমি একটা ছেলেকে চিনি, ছাত্রভিসায় এদেশে এসেছিলো সে। কিছুদিনেই বিলেতের সঙ্গে তার তীব্র প্রেম হয়। ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসে প্রায়। বিলেত বাসে তার ইচ্ছা ফুরোয় না। কিভাবে এদেশে স্থায়ী হওয়া যায়? কেউ একজন বলে, সমকামী হলে সহজেই মিলে স্থায়ী বিলেত বাসের সার্টিফিকেট। ছেলেটি দেশে একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। আসার সময় মেয়েটি তাকে একটা মানিব্যাগ উপহার দিয়েছিলো। বলেছিলো, পকেটে সব সময় আমাকে নিয়ে ঘুরবে। ছেলেটি সেই মানিব্যাগে রাখা তার প্রিয় নারীটির ছবি বদলে অন্য একটি ছেলের ছবি রাখে। নিজেকে সমকামী পরিচয়ের প্রথম পাঠ এটি। তার চালচলন বদলে যায়। হোম অফিসে নিজের অবস্থানের পক্ষে শক্ত কাগজ জমা দিতে মেয়েলি আচরণের খুঁটিনাটি শেখে সে। ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়। চোখে কাজল। কথা বলতে অপ্রয়োজনে অনেক বেশি হাত নাড়ে। নিজেকে সমকামী প্রমাণে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ব্যয় হয় দীর্ঘ সময়। ছেলেটি অভিনয় করে। জীবন নামক নাটক তখন তাকে নিয়ে খেলে। এক সময় ছেলেটি ব্রিটেনে স্থায়ী হয়। সে একা স্থায়ী হয়নি। তার সঙ্গে আরো স্থায়ী হয়েছে তার অভিনয়। স্থায়ী হয়েছে তার অতিরিক্ত হাত নাড়া। আমাকে দুঃখ করে ছেলেটি বলেছিলো, নিজেকে আর ফিরে পাই না। নিজেকে আর আমার মতো করে পাই না। জানতে চাই, দেশে থাকা তার প্রিয় সেই নারীর কথা। ছেলেটি বলে, তার কাছে আর ফিরে যাবো না। আমি আর কোনোদিন কোনো নারীর কাছে যাবো না।
গল্পটা অদ্ভুত। বিলেত এমন কত অদ্ভুত গল্পকে যে সত্যি করে দেয়! এখানকার ব্যস্ত মানুষেরা এমন বহু সূর্যাস্তের খবর জানে না। তারা কেবল দৌড়াতে থাকে। জীবন তাদের দৌড় শেখায়। প্রতিদিন এমন দৌড়ে হাজির হয় নতুন নতুন আরো বহু মুখ। আবার ফিরে যাবার আশ্বাস দিয়ে আসে তারা। কিন্তু ফেরা হয় না।
বিলেত এমন একটা জায়গা, যেখানে থাকতে হলে অনেক কষ্ট গুণতে হয়। সেই কষ্ট গুণতে গুণতে এক সময় ফিরে যাবার শক্তি যে কিভাবে ক্ষয় হয়ে আসে তা কেউ জানে না। কেউ জানতেও চায় না।