আমার মা

:নজরুল ইসলাম:

আজ রোববার ১৩ মে ‘বিশ্ব মা দিবস’। বিশ্বের সকল মাকে উৎসর্গ করার দিন। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার এই দিবসটি বাংলাদেশে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়।

মা দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি মাকে যথাযথ সম্মান দেয়া। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেয়া, ঘরে-বাইরে সর্বেক্ষত্রে অবহেলিত মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষেই বিশ্বের বিভিণ্ণ দেশে মা দিবস পালন করা হয়।

মাকে ভালবাসা জানাতে কোনো দিনক্ষণ লাগে না, তবুও মায়ের জন্য ভালোবাসা জানানোর এক বিশেষ দিন আজ।

মা’ শব্দটির মধ্যে হাজারো আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে। আছে শ্রদ্ধা ভালোবাসা স্নেহ যা লেখনি দিয়ে প্রকাশ করা অসম্ভব।
মাকে নিয়ে একটি বিস্তৃত আর্টিকেল লিখার ইচ্ছা ছিল যাহা নিকট ভবিষতে লিখার ইচ্ছে রয়েই গেল।

আজ বিশ্ব মা দিবস তাই মাকে নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করতে মন বলছে।

মানুষের কর্মব্যস্ত জীবন একটি বিশেষ ক্ষনে, বিশেষ ভাবে কোন বিশেষ মমতাময়ী মাকে সময় দেয়া, মায়ের খোঁজ খবর নেয়ার এই যে প্রয়াস তা আমার কাছে বেশ মহতি উদ্যোগ মনে হয়েছে।

আমার মায়ের ভালবাসার স্মৃতিপঠ লিখতে গেলে উপন্যাস রচনা হবে খন্ডে খন্ডে এর পরও শেষ হবে না মাকে নিয়ে লিখা।

মা আমাদের পরিবারের সকলের জন্য আছেন আল্লাহর এক অশেষ নেয়ামত হিসাবে।

আমাদের বিপদে আপদে কঠিন সময়ে তিনিই প্রথমে হাতে তসবিহ নিয়ে দোয়া করেন, আমাদের সাহস যোগান। আমার মা হচ্ছেন বিশ্বের সেরা মাদের মধ্যে অন্যতম একজন, the best mom in the world ,

আমার মা-আধুনিক পৃথিবীর বাহিরের নির্ভেজাল গ্রামীন পরিবেশে জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছেন আমাদের সুনাগরিক হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করার প্রত্যয়ে। যেখানে ছিলোনা আজকের মত ডিজিটালাইজেশনের পরশ, ছিলোনা আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা।

একটা বৈরী পরিবেশে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন মানবিক মূল্যবোধের ,নীতিনৈতিকতা বোধের ,আচার আচরণ, ভদ্রতা ও নম্রতার।

ঐকান্তিক শ্রম দিয়েছেন আমাদের একাডেমিক শিক্ষার পরিসমাপ্তিতে।

জীবনের প্রতিটি ক্ষনে কিভাবে একজন ভাল মানুষ হওয়া যায় মায়ের আদেশ উপদেশ পরামর্শই আমাদের চলার পথের পাথেয়।

বাবা, সহ আমাদের পরিবারের সকল আমরা মায়ের কাছে চির ঋণী, যে ঋণ কখনো শোধ হবার নয়।

আমার বাবার পারিবারিক সামাজিক রাজনৈতিক বা একজন ব্যক্তি আব্দুন নূর মাস্টার হিসাবে তিনির আজকের এই অনড় অবস্থানের পিছনে আমাদের মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা শ্রম মেধাই গাইড লাইন হিসাবে কাজ করছে।

আমার কাছে প্রায়ই মনে হয় মায়ের অনুউপস্থিতি আমাদের পরিবার হবে অনেকটা মাঝি বিহীন নৌকার মত।

আজকের এই বিশেষ দিনে মায়ের অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে ,বিস্তৃত আলোচনা হবে সময়ক্ষণে।

আজ বিশেষ একটি স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।

আল্লাহ পাক রাব্বুল আল আমিনের অশেষ মেহেরবানীতে কয়েক বছর পূর্বে আমাদের মা বাবা পবিত্র হজ্ব পালনের জন্য সৌদি আরব গমন করেন।

হাসি খুশি সুস্থ শরীর নিয়ে দুজনই পবিত্র হজ্ব সম্পন্ন করেন ,আলহামদুলিল্লাহ।

আমরা পরিবারের সকলই অনেক খুশি আল্লাহর লাখ শুকরিয়া আদায় করছি ,আমিন।

মা যখন হজ্ব পালন করছিলেন আমি ছিলাম লন্ডনে।

সেই সময়টায় আমার শরীর ও মনটা বেশ ভাল ছিলোনা। সৌদি আরবে মাকে ফোন দিতাম, মা বলতেন তোমার বাবা আর আমি আমরা সুস্থ আছি।

তোমাদের জন্য মন খুলে দোয়া করছি। নতুন শহর ,হাজীদের ভীড় ,অনেক মানুষের মত তোমার বাবা ও প্রায়ই নিখুজ হয়ে যান ক্ষনিকের জন্য।

তবে আমাকে তিনি বলেছেন বলেছেন রাস্তা হারিয়ে আমি যদি ক্ষনিকের জন্য তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাই তুমি চিন্তিত না হয়ে হোটেলে চলে যেও ।

বলেছেন, তিনি রাস্তা খুঁজে দেরিতে হলেও আমার কাছে হোটেলে চলে আসতে পারবেন। আমার মা বাবার আত্ববিশ্বাস, একে অন্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এক বিরল দৃষ্টান্ত।

হজ্ব শেষ মা বাবা সৌদিতে হোটেলে অবস্থান করছেন। এক বিকেলে মাকে ফোন রিং হচ্ছে, নো আনসার।

দিত্বীয়বার ফোন দিতেই মা ফোন আনসার করতেই সালাম দিলাম, কুশল বিনিময়ে পর মা আমাকে বললেন, তোমার বাবাকে হোটেলে রেখে হজরত আয়েশা (রাঃ) মসজিদে এসেছি তোমার এক খালাকে নিয়ে তিনি হোটেলে আমাদের পাশের রোমের ভদ্র মহিলা।

মাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন মা ? মা বললেন হজরত আয়েশা (রাঃ) মসজিদে আসার উদ্দেশ্য, তুমি তোমার স্ত্রী আমার দুই নাতিন ইকরা ও সায়মা ইসলামের জন্য উমরা পালন করছি।

পরিবারের সকলের সুখ শান্তি সমৃদ্বির জন্য দোয়া করছি। মায়ের ভালোবাসা আমাকে বাকরুদ্ধ করেছিল, আমার চোখ ভিজে জল পড়ছিল।

মা জানেন,তিনির কোন ছেলের মন ভাল নেই। মা অনুভব করতে পারেন তার কোন সন্তানের শরীর ভালো নেই– তিনিই হচ্ছেন মা।

আজকের এই বিশেষ দিনে স্মৃতির ঢেউ দিচ্ছে আর মাকে মনে পড়েছে ।

মাত্র একটি অক্ষরের শব্দ ‘মা।

পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শ্রেষ্ঠ শব্দ, অর্থে অনবদ্য,স্মৃতিতেও মধুময়। মা ডাক শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক মায়াবী সুন্দর মুখ।

যে মুখে লেগে থাকে স্নেহ মমতা আর ভালোবাসা। মা শব্দের মধ্যেই পৃথিবীর সব ভালোবাসা আর আবেগের সম্মিলন। সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপন,সবচেয়ে প্রিয় তার মা।

শুধু আমার না পৃথিবীর সব মানুষের মনে রয়েছে মায়ের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। কেননা সম্পর্কের বেড়াজাল ছিন্ন করে সবাই দূরে সরে যেতে পারে, চলে যেতে পারে প্রিয়সীও। কিন্তু মা’র স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন কখনই ছিন্ন হওয়ার নয়। মা এমন একজন যিনি সারাজীবন সন্তানকে বুকের মধ্যে আগলে রাখেন।

নারী পুরুষ ধনী গরিব দেশ বিদেশ কোথাও কারো সঙ্গে মা এর কোন দন্ড নেই, নেই কোন বিভেদ, নেই তারতম্য,সবাই সমান সুন্দর।

নারী পুরুষ ভেদাভেদের বাহিরে মা একটি নিজেস্ব স্বত্বা একটি সত্য। আর তাই মায়ের কাছে ছেলে মেয়ে সকল সন্তানই সমান, মা সার্বজনীন।

মা ভালবাসা একটি পরম মমতা।

বিশ্বের অনেক দেশে কেক কেটে মা দিবস উদযাপন করা হয়।

তবে মা দিবসের প্রবক্তা আনা জার্ভিস দিবসটির বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, মাকে কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর অর্থ হলো, তাকে দুই কলম লেখার সময় হয় না।

চকলেট উপহার দেয়ার অর্থ হলো, তা নিজেই খেয়ে ফেলা। আনা জার্ভিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর ও ওহাইওর মাঝামাঝি ওয়েবস্টার জংশন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তার মা অ্যান মেরি রিভস জার্ভিস সারা জীবন ব্যয় করেন অনাথ-আতুরের সেবায়।

মেরি ১৯০৫ সালে মারা যান। লোকচক্ষুর অগোচরে কাজ করা মেরিকে সম্মান দিতে চাইলেন মেয়ে আনা জার্ভিস। অ্যান মেরি রিভস জার্ভিসের মতো দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব মাকে স্বীকৃতি দিতে আনা জার্ভিস প্রচার শুরু করেন। সাত বছরের চেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় স্ব্বীকৃতি পায় মা দিবস।

সন্তানের জন্য গর্ভধারিনী মাকে ভালবাসার জন্য কোন বিশেষ দিন থাকে না তার পরেও আনুষ্টানিক ভাবে অন্তত একটি দিন মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা ও নানা ভাবে নিজ মায়ের মহিমা সুযোগ আসে এই মা দিবসে। আমাদের উচিত সময় নিয়ে একটু ভাবা সন্তান হিসাবে আমি কি আমার মায়ের দায়িত্ব পালন করছি ? কোথায় আমার অবহেলা।

আমরা যদি আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি আমরা কি আমাদের মায়ের যথার্থ সেবা-যত্ন করছি ? উত্তর হয়ত হবে হুম ! হয়ত বা করছি না। কেন করছি না? কেন মায়ের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সন্তান হয়ে যথার্থ দায়িত্ব পালন করছি না ? এর জবাব কি দিতে পারবেন ?
দেখেন আমাদের মধ্যে তারাই হচ্ছেন সবচেয়ে দুর্ভাগ্যবান যারা প্রিয় মাকে কাছে পেয়েও মায়ের পদচরণে নিজেকে সমর্পণ করতে পারেননি। মায়ের দুঃখ, কষ্ট, বেদনায় পাশে থাকতে পারেননি।

দুঃখ জনক হলেও সত্য অনেক মাকে নির্মমতায় আশ্রয় নিতে হয়েছে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে অথবা অন্য কোথাও।
যাদের মা নেই অথবা মা অর্থের মাধুর্য বোঝার আগেই শৈশব-কৈশোরে মাকে হারিয়েছেন তারাই সবচেয়ে বেশি বোঝেন মাহীন এই পৃথিবী কত বিষাদময়, কত শূন্য, কতটা দীর্ঘশ্বাসে ভরা, শত বেদনায় জর্জরিত।

মায়ের মর্যদা বিষয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন পবিত্র আল কোরআনে বহুবার বলেছেন।

একবার আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এর নিকট এক ব্যক্তি জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর নবী আমার জীবনে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি কে ? আল্লাহর নবী উত্তর দিলেন তোমার মা। ব্যক্তিটি জানতে চাইলেন এরপর কে ? আল্লাহর নবী জবাব দিলেন তোমার মা। উক্ত ব্যক্তি আবার জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর নবী এরপর কে? মহানবী (স:) আবার জবাব দিলেন তোমার মা।

এরপর উক্ত ব্যক্তি চতুর্থবার আল্লাহর নবীর কাছে জানতে চাইলেন, হে মহানবী এরপর কে? এবার আল্লাহর নবী বললেন, তোমার পিতা।

এই হাদিসটি থেকে আমরা বুঝতে পারি মহান আল্লাহ ও আল্লাহর নবীর কাছে মায়ের মর্যাদার জায়গাটি কোথায়। মায়ের সেবা-যত্ন প্রতিটি সন্তানের পবিত্র দায়িত্ব।

আমাদের কর্মব্যাস্ত জীবনে নানা প্রতিবন্দকতাকে ঠেলে হলেও আমাদের মাকে মায়ের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত।

আমার লিখা পড়ে আবার আপনার বলবেননা না বাবাকে কি অবহেলা করব ? না ,বাবা মাকে আমরা সম্মান করব কাউকে অবহেলা করা উচিত নয়।

আমাদের বয়োজোষ্ঠ বাবা-মা যাতে কোনো ধরনের কষ্ট না পান সেই বিষয়টি দেখা প্রতিটি সু -সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। কোনো অবস্থাতেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা উচিত নয়।

বাবা-মাকে আজীবন নিজের কাছে রেখে সেবা-যত্ন করা প্রতিটি সন্তানের পবিত্র দায়িত্ব।

শুধু মায়ের স্বাস্থ্য নয়, কোনো ভাবেই যেন মা সামান্যতম কষ্ট না পান তার দিকে খেয়াল রাখা উচিত।

আমাদের বয়োজোষ্ঠ বাবা-মা যেন কখনই নিঃসঙ্গতায় না ভোগেন সেই বিষয়টি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে নিশ্চিতে ।

আব্রাহাম লিংকন ও দিয়াগো ম্যারাডোনার মা নিয়ে দুটি উক্তি দিয়েই মা দিবসের স্মৃতিচারণ মূলক শেষ করতে হবে।
আব্রাহাম লিংকন বলেছেন – যার মা আছে সে কখনই গরীব নয়
দিয়াগো ম্যারাডোনা বলেছেন -আমার মা মনে করেন আমিই সেরা, আর মা মনে করেন বলেই আমি সেরা হয়ে গড়ে উঠেছি।

আসলেই মায়ের কাছে সন্তানরা হিরোর টুকরা।

নজরুল ইসলাম
ব্লগার ,ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস NHS লন্ডন
মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিষ্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম
আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন।
trade.zoon@yahoo
Advertisement