চীনে সারাফতের টেনিস একাডেমি

ব্রিট বাংলা ডেস্ক : সারাফত আবেদীন চীনে গিয়েছিলেন টেনিস কোচ হিসেবে। এরপর এক চীনা বন্ধুর সহায়তায় সে দেশে নিজেই চালু করেছেন টেনিস একাডেমি। পরিসর বাড়ার পর দেশ থেকে একে একে নিয়ে গেছেন আরও আটজন কোচকে। এখন নয়জন বাংলাদেশি মিলে চীনের ডংজুয়ান শহরের নানা বয়সী খেলোয়াড়দের টেনিস শেখাচ্ছেন। সারাফতের একাডেমি নিয়েই এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।

চীনের গুয়াংটোং প্রদেশের শহর ডংজুয়ান। ঐতিহ্যের এই ডংজুয়ান চীনের চতুর্থ শিল্পনগরী। আর এই শহরেই এক বাংলাদেশি গড়ে তুলেছেন টেনিস খেলার পাঠশালা।

ডংজুয়ান শহরের টেনিস শেখানোর এই পাঠশালার উদ্যোক্তা সারাফত আবেদীন। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘গ্যালপ টেনিস একাডেমি’। এখানে প্রায় ৪০০ জন চীনা শিশু-কিশোর এবং নানা বয়সী মানুষ টেনিসের সবক নিচ্ছেন। সারাফত আবেদীন নিজেও একজন কোচ। তাঁর সঙ্গে কোচ হিসেবে আছেন আরও আটজন বাংলাদেশি তরুণ।

সারাফত আবেদীনসারাফত আবেদীনজ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যাওয়ার কথা প্রচলিত রয়েছে। তবে চীন দেশে জ্ঞান বিতরণের জন্যও যে অনেকে যান, তার প্রমাণ যেন বাংলাদেশি এই তরুণেরা। এই টেনিস একাডেমির গোড়াপত্তন নিয়েই আলাপ হচ্ছিল সারাফত আবেদীনের সঙ্গে। ইন্টারনেটে আমরা যেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত, চীনে তার বেশির ভাগই নেই। তাই বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ উইচ্যাটই ভরসা। উইচ্যাটেই কথা হলো সারাফতের সঙ্গে।

২০০৬ সালের কথা। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) টেনিসের শিক্ষার্থী ছিলেন সারাফত আবেদীন। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সহকারী কোচ হিসেবে চাকরি নেন বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনে। এক বছর চাকরি করেন। এরই মধ্যে প্রস্তাব পান চীনের এক একাডেমিতে টেনিস কোচ হিসেবে কাজ করার।

সারাফত আবেদীন বলছিলেন, ‘আমাদের বিকেএসপির ছোট ভাই আখতার হোসেন আগে থেকেই চীনে কাজ করে। সে এ সুযোগ করে দিয়েছিল। ২০০৭ সালে চীনের বেইজিংয়ে চলে যাই।’

এরপর কয়েক বছর বেইজিংয়ের আশপাশের কয়েকটি টেনিস একাডেমিতে সারাফাত টেনিস কোচ হিসেবে কাজ করেন। তত দিনে চীনা ভাষাটাও মোটামুটি রপ্ত করেছেন সারাফত আবেদীন। তাই হয়তো চাকরি ছেড়ে নিজেই কিছু করার স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করে তখন।

পরিচয় হলো ইউ চিয়েনের সঙ্গে
নিজে যখন কিছু করার কথা ভাবছিলেন, তখন সারাফত গুয়াংটো প্রদেশের একটি টেনিস একাডেমির কোচ। সেখানে ইউ চিয়েন নামে এক টেনিস-অনুরাগীর সঙ্গে পরিচয়। চিয়েন পেশায় চিকিৎসক। ভাষা জানা বলে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। এই বন্ধুত্বই নতুন এক সম্ভাবনা এনে দেন সারাফতের সামনে। কারণ টেনিস কোচ হিসেবে পেশাগত জীবনে টিকে থাকার লড়াইটা ভালোভাবে বুঝতে পারছিলেন সারাফত। চিয়েনের সঙ্গে একটি টেনিস একাডেমি চালুর আলাপ পাকা হয়। এককথায় রাজি হন এই চীনা চিকিৎসক। চলে যান গুয়াংটোং প্রদেশের ডংজুয়ান শহরে। ২০১২ সালের ঘটনা এটি। সে বছরই ডংজুয়ান সিটি কাউন্সিলের অনুমোদন পেয়ে গ্যালপ টেনিস একাডেমির গোড়াপত্তন হয়। প্রতিষ্ঠাতা সারাফত আবেদীন ও ইউ চিয়েন।টেনিস কোর্টে নামার আগে একটু দৌড়!
প্রশিক্ষণার্থী মাত্র একজন
একজন প্রশিক্ষণার্থী নিয়েই শুরু হয়েছিল গ্যালপ টেনিস একাডেমির। সারাফত আবেদীন বললেন, ‘সেটাও বিনা পয়সায়। তার কাছে থেকে আমরা ফি নিইনি।’ এক, দুই, তিন…এভাবেই বাড়তে থাকে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা। সাফল্য আসে, চারদিকে সুনাম ছড়ায় একাডেমির। পরিসর বাড়তে থাকলে প্রয়োজন হয় কোচের। সারাফত আবেদীন তখন দলে ভেড়ান দেশে পরিচিতদের। তাঁর ডাকে বাংলাদেশ থেকে একে একে আটজন চলে যান চীনে। এই কোচদের কেউ বিকেএসপির টেনিস দলের সদস্য ছিলেন, কেউবা খেলেছেন নিজ শহরে। যেমন শরীফ আবেদীন, রাইসুল ইসলাম, শেখ হাসিবুল হক এবং উ শুয়ে শুয়ে বিকেএসপিতে টেনিসের শিক্ষার্থী। সবাই বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের খেলোয়াড় হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড সফর করেছেন।

বাংলাদেশি কোচের হাতে এভাবেই হয় টেনিসের হাতেখড়ি

মোস্তাফিজুর রহমান ও সাদির হোসেন রাজশাহী টেনিস একাডেমি থেকে বেরিয়েছেন। আরিফ বিন ইসলাম নওগাঁয় টেনিস খেলেছেন। জামিল ভূঁইয়া ঢাকায় বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের সহকারী কোচ ছিলেন।

সারাফত আবেদীন বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়াও দুজন সার্বীয় কোচ রয়েছেন গ্যালপ টেনিস একাডেমিতে; আছেন ছয়জন চীনা কর্মী। ডংজুয়ান স্পোর্টস সেন্টারে আটটি কোর্ট ইজারা নিয়ে আমরা এখন ৪০০ ছেলেমেয়েকে টেনিসের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এ ছাড়া এখানকার একটি গলফ ক্লাবের দুটি কোর্টেও প্রশিক্ষণ করানো হয়।’

টেনিস কোর্টে এক চীনা শিশুটেনিস কোর্টে এক চীনা শিশুযেভাবে চলে একাডেমি
কোচ শেখ হাসিবুল হক ও সাদির হোসেন কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছেন। শেখ হাসিবুল হকের কাছেই জানা গেল একাডেমির কার্যক্রম সম্পর্কে। তিনি বলছিলেন, ‘একাডেমিতে বয়স অনুযায়ী টেনিস শেখানো হয়। আবার তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি কোর্সও আছে। এসব কোর্সে অনেকে যেমন আসেন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় হতে, আবার কেউ কেউ আসেন শখের বশে কিংবা স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে।’

মূলত ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যাই বেশি তাঁদের একাডেমিতে। কারণটাও অবশ্য তিনি জানালেন, মাধ্যমিকে উঠে গেলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় চাপ বাড়ে, তখন অনেকেই টেনিস খেলা ছেড়ে দেয়।

তাঁদের একাডেমিতে টেনিস শিখতে কেমন খরচা হয় তার একটু আঁচ পাওয়া গেল আলাপের সময়। প্রতিটি লেসনের ফি ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। এককালীন ফি দিয়েও টেনিস একাডেমিতে ভর্তি হওয়া যায়। সারাফতরা শুধু কোর্টে টেনিস বল নিয়ে খেলা শেখান না। ব্যায়াম, জগিং, ট্র্যাকে দৌড় ও সাঁতারও শেখান। তবে এসব প্রশিক্ষণের সময় ভাষা বাধা হয়ে দাঁড়ায় কখনো কখনো।

সারাফাত আবেদীন যেমন বলেছিলেন, ‘চীনারা ইংরেজি বোঝে না। বলতেও আগ্রহ দেখায় না। টেনিসে কারিগরি শব্দ আছে ইংরেজিতে, সেগুলো শেখানো হয়। শুরুতে এসব নিয়ে সমস্যা হতো। এখন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে যেসব ছেলেমেয়ে আসে, ওরা ইংরেজি কিছুটা বলতে পারে। এখন আমরাও চীনা ভাষায় কথা বলতে পারি। খুব একটা সমস্যা হয় না।’

বাংলাদেশি দুই কোচের সঙ্গেবাংলাদেশি দুই কোচের সঙ্গেবিদেশি প্রশিক্ষকে আস্থা
ডংজুয়ানের শিল্পনগরী আয়তন আর এখানকার অধিবাসীদের অর্থবিত্তের কারণে খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এ জন্য বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে শেখার আগ্রহ বাড়ছে ডংজুয়ানবাসীর। শহরটিতে চীনাদের একাডেমি রয়েছে অসংখ্য। তারপরও বিদেশিদের কাছে টেনিস শেখাতে পাঠান ডংজুয়ানের অভিভাবকেরা। গ্যালপ টেনিস একাডেমি হয়তো সে সুযোগটা ভালোই কাজে লাগাতে পেরেছে। সারাফত জানালেন শুধু এটিই বড় কারণ নয়। গ্যালপ টেনিস একাডেমির কয়েকজন শিক্ষার্থী বেশ সাফল্যও পেয়েছে। একাডেমি থেকে অনূর্ধ্ব-১৮ কোর্স শেষ করে ছেন আই ছি নামে এক মেয়ে ডব্লিউটিএ র‍্যাঙ্কিংয়ে নাম লিখিয়েছে। ডংজুয়ানে অনূর্ধ্ব-১০ টেনিস টুর্নামেন্টে ২০১৮ সালে শিরোপা জয় করেছে গ্যালপের অ্যানি ও কোলেন নামে দুই খুদে টেনিস খেলোয়াড়। আর এমন সাফল্যে ডংজুয়ান ইয়াং টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে খেলোয়াড়দের কোচিং করানোর দায়িত্ব পায় গ্যালপ টেনিস একাডেমি।

এমন সুযোগ আর সম্ভাবনা কাজে লাগিয়েই নিজেদের মেধার পরিচয় দিচ্ছেন বাংলাদেশি কোচরা। তাঁদের হাত ধরেই বাংলাদেশের নাম পৌঁছে যাচ্ছে সুদূর চীনে।

Advertisement