জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের দুর্নীতি মামলা !

:ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী:

বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুল আলোচিত একটি মামলা হলো জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের দুর্নীতি মামলা।

মামলা গুলোর শুরু ২০০৮ সালে আর বিচারের রায়ের তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমার মনে হয় এতো লম্বা সময় কোন মামলা চলেনি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্বে দায়ের করা এই মামলার অভিযোগ গুলো সম্পর্কে সকলের মতো আমার ও আগ্রহের কমতি ছিলনা। তাই অনেক ঘাটাঘাটি করে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলার অভিযোগ গুলো জানার চেষ্টা করেছি।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা দুদক। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। এদের মধ্যে কাজী সালিমুল হক কামাল এবং শরফুদ্দিন আহমেদ জামিনে আছেন। তারা আদালতে হাজির ছিলেন। মামলার অপর আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে আছেন। তার পক্ষে তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতে হাজিরা দেন। অপর দুই আসামি কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন।
এছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় আরও একটি মামলা করে দুদক। এ মামলার অপর আসামিরা হলেন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এদের মধ্যে জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান জামিনে আছেন। আর হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু থেকেই পলাতক। পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত-৩-এর অস্থায়ী এজলাসে এই দুটি মামলার কার্যক্রম চলে।
১৯৯১-৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সোনালী ব্যাংকের রমনা শাখায় খালেদা জিয়ার পক্ষে ২ জুন ১৯৯১ তারিখে ‘প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল’ নামে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয়। যার চলতি হিসাব নম্বর ৫৪১৬। বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগ ১৯৯১ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আত্মার মাগফেরাতে কুয়েতের আমির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে একটি অনুদান প্রধান করেন।যা ওই এ্যাকাউন্টে ১৯৯১ সালের ৯ জুন ইউনাইটেড সৌদি কর্মাশিয়াল ব্যাংকের ডিডি নম্বর ১৫৩৩৬৭৯৭০ মূলে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলার যার মূল্য ততকালীন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে বাংলাদেশি টাকায় ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা অনুদান হিসেবে জমা হয়। দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ১৯৯১ সালের ৯ জুন থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া এই অর্থ কোনো এতিমখানায় প্রদান করেননি। এই সময়ের মধ্যে তার পুত্র তারেক রহমান, আরাফাত রহমান ও ভাগ্নে মমিনুর রহমান জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেন। যদিও এই ট্রাস্ট গঠনের প্রক্রিয়ায় আরাফাত রহমানের কোন সাক্ষর ছিল না। তাই তাকে এ মামলায় আসামী করা হয়নি। জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গুলশান সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ট্রাস্টের নামে নিবন্ধন করা হয়। যার ঠিকানা হিসেবে সেনানিবাসের ৩ শহিদ মঈনুল রোডের বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। এ সময় তারেক রহমানকে দি অথর অব দি ট্রাস্ট তথা দি সেটেলর নিয়োগ করা হয়। এরপর বগুড়ায় একটি এতিমখানা স্থাপনের জন্য ১৯৯৩ সালের ১৩ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের রমনা শাখার তৎকালীন হিসাব নম্বর ৫৪১৬ এর (খালেদা জিয়ার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল) অনুদানের টাকা গুলশানের নিউনর্থ সার্কেল শাখায় (এসটিডি হিসাব নম্বর-৭) মূলে ১৫ নভেম্বর বর্তমান হিসাব নম্বর ৭১০৫৪১৬৪ এ ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা ট্রান্সফার করা হয়। ঐ একই তারিখে সমপরিমাণ টাকা ট্রান্সফার করা হয় জিয়া মেমোরিয়াল ট্রাস্টে।
দুদক সূত্র জানায়, ১৯৯৩ সালের ৪ ডিসেম্বর (চেক নম্বর ৪৮৮২৪০১) ৪ লাখ টাকা তুলে বগুড়া জেলার গাবতলী থানার দাড়াইল মৌজায় ১৭টি দলিল মূলে ২ দশমিক ৭৯ একর জমি ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকায় ক্রয় করা হয়। এরপর ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অনুদানের বাকি টাকা অন্য কোনো স্থাপনা বা দুস্থদের কল্যাণে অর্থ ব্যয় না করায় ওই হিসাবে ২০০৬ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সুদসহ জমা পড়ে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৯ হাজার ৭৫৭ টাকা। দুদকের সূত্রটি জানায়, তারেক রহমান ও মমিনুর রহমানের যৌথ স্বাক্ষরে ২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল, ১৫ জুন এবং ৪ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে সর্বমোট ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখায় এফডিআর খোলার জন্য হস্তান্তর করা হয়। এদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের আসামী মাগুরার সাংসদ ও ব্যবসায়ী কাজী সলিমুল হক ট্রাস্টের সাথে কোনোভাবে সংযুক্ত না থাকার পরেও গত ২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল ৫০ লাখ টাকার একটি এফডিআর খোলেন। যা জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্টের একাউন্ট থেকে ট্রান্সফার করা হয়। এরপর এই শাখায় কাজী সলিমুল হকের নামেই পরবর্তীতে ২ কোটি টাকার আরো দু’টি এফডিআর খোলা হয়। যা তিনি নিজ নামেই ট্রান্সফার করেন। এছাড়াও একই মামলার আরেক আসামী ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের ছেলে সৈয়দ আহমেদের নামে একটি ১ কোটি টাকা এবং দুজনের যৌথ নামে আরেকটি ১ কোটি টাকার এফডিআর খোলেন কাজী সলিমুল হক। এদের মধ্যে সৈয়দ আহমেদ এখন মৃত। এই দুই এফডিআর থেকে গিয়াস উদ্দিন আহমেদের এফডিআরে ট্রান্সফার হয়। এর কিছুদিন পরই গিয়াস উদ্দিন আহমেদ তার এফডিআরের এক কোটি টাকা ভেঙে ৫০ লাখ টাকার ২টি এফডিআর করেন। এরপর আবার সেই এফডিআর ভেঙ্গে শরফুদ্দিনের একাউন্টে ৬টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে টাকা ট্রান্সফার করেন। শরফুদ্দিন ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা তুলেন। অনুসন্ধানে দুদক জানতে পারে, কাজী সলিমুল হকের কাছে সরফুদ্দিন আহমেদ এই পরিমাণ অর্থ পেত। মূলত এরপরই এই টাকা জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্টের তহবিল থেকে বেরিয়ে যায়। যা আইনত অবৈধ। কারণ ট্রাস্টের টাকা শুধুমাত্র ট্রাস্টের কল্যানেই ব্যয় করারই নিয়ম রয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সেই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা আত্মসাত ছাড়াও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলায়ও বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে জমি ক্রয়ে গুরুতর তথ্য ও প্রমাণ রয়েছে দুদকের কাছে। তিনি ট্রাস্টের ক্রয়কৃত জমির মূল্য দেখিয়েছিলেন ৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা কিন্তু দুদকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ৪২ কাঠা জমি মূল্য পরিশোধের সময় জমির মালিক তারেক জিয়ার চাচী শাশুড়ি সুরাইয়া খানমকে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। যার ফলে জমির মূল্য হিসেবে জমির মালিককে ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত প্রদান করা হয়। কিন্তু এই টাকা কোন উৎস থেকে প্রদান করেছেন সেই তথ্যও উপস্থাপন করতে পারেননি বেগম জিয়া। জমি মালিককে দেয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০১-০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সেনানিবাসের মঈনুল রোডের ঠিকানা ব্যবহার করে এই জমি ক্রয় করেন। গুলশান সাব রেজিট্রি অফিসে এ জমির নিবন্ধন করা হয়। মূলত বেগম জিয়ার দু’টি ট্রাস্ট গঠনে একই ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। এসব অনিয়মের সাথে জড়িত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। এছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে বাকী ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের নামে দেয়া হয়। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ায় এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারেনি দুদক।
ট্রাস্টের কর্মকান্ডে অনুদানের টাকা ব্যবহার না করার প্রশ্নে খালেদার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহাবুব হোসেনর দাবি, ট্রাস্টের কেউ তো মামলা করেনি। আর টাকাগুলো ট্রাস্টের কাজে ব্যবহার হয়নি, তবে তা আত্মসাতও করা হয়নি। তিনি বলেন, ওই টাকা থেকে তুলে জায়গা কেনা হয়েছিল। টাকাটা দু’টি ভাগে ভাগ করেই এই জায়গা কেনা হয়েছিল। কিন্তু জায়গা নিয়ে যখন গন্ডগোল হয়, তখন মামলা করা হয়। মামলার পর সেই টাকা ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো এখানে আত্মসাত তো হয় নাই। সেক্ষেত্রে আত্মসাত যদি না হয় আর ট্রাস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী এবং একমাত্র ট্রাস্টি যারা, তারাই মামলা করতে পারেন। আর তারা যদি মামলা না করে তবে সরকারের মামলা করার কোন অধিকার-ই নাই। জায়গা কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা ট্রাস্টের টাকা। আর ট্রাস্টের টাকা দানের টাকা। আর উৎস যদি নাই দেখাতে পারে তবে দুদক বা সরকারের কি ক্ষতি হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল মামলার চার্জ গঠনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে আপিল আবেদন করা হয় । যেটির শুনানী দিন ছিলো ৬ নভেম্বর সেখানেও আদালত বেগম জিয়ার আবেদন বাতিল করে দেন।
জানা গেছে, বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বিচার শুরুর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও চ্যারিটেবল ট্রাস্টের দু’টি মামলায় সর্বমোট ৫১ বার শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এজন্য বারবার আদালতে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেন বেগম খালেদা জিয়া। শুনানির দিনগুলোর নভেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত বেগম জিয়া মাত্র ৫ বার উপস্থিত ছিলেন। ব্যক্তিগত স্বাক্ষ্য দেয়ার জন্য মোট বরাদ্ব ছিলো ২৮ দিন আর যুক্তিতর্কের জন্য ছিলো মোট ১৬ দিন।

লেখক: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী প্রিন্সিপাল সলিসিটার, কেসি সলিসিটর্স,ইউকে, পরিচালক, সেন্টারফরব্রিটিশ-বাংলাদেশীপলিসি ডায়ালগ সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সহসভাপতি দি সোসাইটি অব ব্রিটিশ-বাংলাদেশী সলিসিটর্স

Advertisement