ডিটক্স

মো. সাখাওয়াত হোসেন ::  আমাদের বন্ধুমহলে রমি সবচেয়ে স্বাস্থ্যসচেতন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ওর ছাতি আর মাসল দেখে সবাই অবাক হতো। স্কুলের স্যাররা ওকে মারার আগে বলতেন, ‘তোরে আর কী মারুম? খাইয়া খাইয়া যে হাতি হইছস!’

সেই রমির নাম আমরা দিয়েছিলাম ‘রমি পালোয়ান’। বন্ধু বিল্টু ওর নাম পাল্টে দেয় রমা। এরপর সেটা পাল্টে হয় রমা পালোয়ান। বিল্টুর যুক্তি ছিল, ‘গামা পালোয়ানের সঙ্গে মিল রেখে রমা পালোয়ান।’

এরপর অনেক দিন পার হয়েছে। অনেক নির্বাচন হয়েছে, অনেক সরকার পাল্টিয়েছে, অনেক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে; কিন্তু আমাদের রমা পালোয়ানের পরিবর্তন হয়নি। সে এখনো তার দুর্দান্ত ফিটনেস, নিখুঁত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে পড়ে আছে।

সেদিন বিকেলে পাড়ার মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে রমা বলল, ‘তারেকের দেখি এখনো মুখে ব্রণ। আর বিল্টুর স্বাস্থ্য এখনো দেখি পাটকাঠি।’

‘শুরু হইছে!’ বিড়বিড় করলাম।

‘তোর দেখি চুল উঠে যাচ্ছে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বলল সে।

‘তো কী হইছে এখন?’

‘ডিটক্স করোস না বলেই তো এই অবস্থা!’ রমা গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

‘কী কস?’ বিল্টু বলল।

‘কী কস না হালা। ডিটক্স, ডিটক্স। ডিটক্স (Detox) মানে হচ্ছে পুরো শরীর পরিষ্কার করার একটা উপায়।’

‘ডিটক্স লাগে নাকি পুরো শরীর পরিষ্কার করতে? ডেটল সাবান হলেই তো হয়।’ বিল্টু মাঝখান দিয়ে বলল।

‘শোন অশিক্ষিত, বর্বর হিপোপটেমাস। ডিটক্স দিয়ে বাইরের না, শরীরের অভ্যন্তরীণ ময়লা পরিষ্কার করা হয়।’

‘আরে ধুর! অভ্যন্তরীণ ময়লা পরিষ্কার করে কি করব?’ বিল্টু এটা বলতেই রমা রেগেমেগে উঠে যাচ্ছিল। আমরা থামালাম।

‘আরে রাগোস ক্যান? বল বল। কী করতে হবে পুরোটা বল।’

এরপর রমা আমাদের পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল, ‘ডিটক্স করলে শরীরের ভেতরে আমাদের বিভিন্ন রকমের যে ময়লা জমা থাকে, তা বের হয়ে যায়। ত্বক ভালো থাকে, চুল ভালো থাকে।’

‘এটা করব ক্যামনে?’ তারেক জিজ্ঞেস করল। সে একটু ত্বকসচেতন।

‘ডিটক্স করার অনেক উপায় আছে। এর মধ্যে একটা হলো সকালে খালি পেটে কুসুম গরম পানিতে মধু আর লেবুর রস দিয়ে পান করা। এ ছাড়া আরেকটা পদ্ধতি হলো লবণ পানি খেয়ে একটু অপেক্ষা করে টয়লেটে যাওয়া। এ ছাড়া আরো কিছু জুস আছে। যেমন—আদা, পুদিনা এগুলো ব্লেন্ড করে খাওয়া।’

‘এ তো সহজ কাজ। কাল থেকে শরীর পরিষ্কার করে ফেলব।’ এই বলে বিল্টু চলে গেল।

পরদিন সকালে শুনি বিল্টুর অবস্থা খারাপ। খালি পেটে লেবুর রস খাওয়ায় অ্যাসিডিটি বেড়ে গেছে। লবণ পানি খেয়ে আমার গেছে প্রেসার বেড়ে। তারেকের খবর এখনো জানি না। তারেকের বাসায় দুজনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গেলাম।

বেল বাজাতেই দরজা খুলল তারেকের বাবা। তাঁকে আমরা সবাই খুব ভয় পাই। তিনি একসময় শিক্ষক ছিলেন।

‘আংকেল তারেক আছে?’

‘হ্যাঁ, আছে তো। রমা কে তোমাদের মধ্যে?’

‘রমা? ও তো আসেনি।’ তোতলিয়ে কোনো মতে বলল বিল্টু।

‘ছেলে, নাকি মেয়ে ও?’

‘ইয়ে ছেলে। আসলে ওর নাম হচ্ছে আংকেল রমি। আমরা রমা ডাকি। রমা পালোয়ান।’ চোখের ইশারায় কাজ হলো না। বিল্টু সব বলে দিল।

‘পালোয়ান? আচ্ছা ভেতরে আসো।’

‘এই ভীম পালোয়ান, আমার ছেলেকে কী খেতে বলছে? ওগুলো খেয়ে ওর কাল থেকে ডায়রিয়া। হাতের পানি শুকাচ্ছে না।’

‘এটাই তো ডিটক্স আংকেল। শরীরের সব ময়লা বের হয়ে যাচ্ছে।’ বিল্টু কথাটা বেশিই বলে।

‘আমার ছেলের ময়লা দরকার হলে আমি বের করব। তোমাদের ওই পালোয়ানের তেল বেশি হয়ে গেছে। ওটাও বের করতে হবে।’

আমরা তারেকের রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি সে বিছানায় শুয়ে ইঁদুরের বাচ্চার মতো চিঁচিঁ করছে।

‘কি রে ময়লা বের হইছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘খালি ময়লা না দোস্ত, নাড়ি-ভুঁড়িও বের হয়ে যাচ্ছে।’

এর সাত দিন পর আমরা পবনদার চায়ের দোকানে বসা।

আমাদের তিনজনকে দেখে মনে হচ্ছে ঝড়ো কাক। ডেটক্সের ঠেলায় অবস্থা কেরোসিন। এদিকে রমা তার কোনো এক দিদির বিয়ে খেতে গ্রামে গেছে।

আমাদের চেহারার অবস্থা দেখে পবনদা জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইডি, এই দশা ক্যান আপনাগো?’

‘পেট ক্লিয়ার করতে গিয়ে লতাপাতা আর লবণ পানি খেয়ে এই অবস্থা।’ আমি বললাম।

‘আরে পেট ক্লিয়ার করতে এসব কাম করতে হয় কে কইছে? খালি পেটে এক গ্লাস জল খাইয়া আমার দোকানের এক কাপ চা, আরেকটা সেঁকা পরোটা খাইয়া একটু হাঁইটা আইবেন। পেট, দিল, মাথা সব ক্লিয়ার হইয়া যাইব।’

আমরা সেটাই করা শুরু করলাম। প্রতিদিন সকালে পবনদার এক কাপ চা, আরেকটা সেঁকা পরোটা। কোষ্ঠকাঠিন্যের জগতে তোলপাড়। আগে টয়লেটে বসে আমাকে ‘অপরাধী’ গানটা পুরো গাইতে হইত। এখন মোটামুটি দ্বিতীয় প্যারার দিকেই কাজ শেষ করে বের হয়ে যেতে পারি।

রমি ফিরলে আমাদের দেখে বলল, ‘আরে তোদের দেখি চেহারা ছবি হেভি পরিবর্তন। ডিটক্স কাজ করতেছে না?’

‘ডিটক্স না হালা। কাজ করতেছে চাপক্স।’

‘এইটা কী?’ অবাক রমি।

‘এইটা হলো চা, পরোটা রক্স। চাপক্স!’ বিল্টুর ব্যাখ্যা শুনে আমরা তিনজন হা হা করে দিল খুলে হেসে উঠলাম। পবনদার কথা ভুল না। পেটের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দিলও পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।

Advertisement