তনু, নুসরাতদের মায়ের কান্না না থামালে আমাদেরও যে কাঁদতে হবে একদিন

ফারজানা ইসলাম লিনু

এই পৃথিবীতে মানব সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়স্থল দিনকে দিনকে সংকুচিত হয়ে আসছে। বিদ্যার্জনের অধিকতর ও নিশ্চিত সুরক্ষার কথা চিন্তা করে বাবা মা কন্যাশিশুর জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশী বেশী।

কিন্তু কন্যা শিশুর সুরক্ষা যে সর্বত্রই ভুলন্ঠিত। লেবাসধারী পশু ও বিকৃত রুচির লোকেরা সব জায়গায় তাদের শিকড় প্রসারিত করছে। জৈবিক লালসা চরিতার্থ করার বাসনায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন অভয়াশ্রম। কি অবলীলায় একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে অমিত বিক্রমে পার পেয়ে যাচ্ছে দুঃশ্চরিত্রবানলোকগুলো।

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নামধারী এক পশুর লালসার শিকার হয় নিষ্পাপ মেয়েগুলো। সামাজিক নিরাপত্তা ও লোক লজ্জার ভয়ে মেয়েরা মুখ বুজে সয়ে যায় সব অনাচার। এই সুযোগে বাড়তে থাকে প্রবল ক্ষমতাধর এক অন্যায়কারীর অপরাধের মাত্রা।

সোনাগাজীর নুসরাতের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সিরাজউদ্দউলা নামের এই পশুর আসল চেহারা লোক চক্ষুর সম্মুখে চলে এসেছে। একে একে বেরিয়ে আসছে তার নানা অপকর্মের কাহিনী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় বইছে নিন্দার ঝড়। অথচ এই বর্বর লোকটাকে বাঁচানোর জন্য মানববন্ধন পর্যন্ত হয়েছে ফেনীর রাজপথে।

নির্যাতিত মেয়েদের পরিবার ভয়ে প্রতিবাদ করেনি আগে। আবার কেউ কেউ প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পায় নি। উল্টো হয়রানির শিকার হয়ে সইতে হয়েছে নানা গঞ্জনা।

ভুক্তভোগী মেয়েগুলোর পাশে দাঁড়ানোর কারণে মাদ্রাসার অনেক বিবেকবান শিক্ষককেও পড়তে হয়েছে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দউলা নামক সেই পশুর রোষানলে। ক্ষমতার দাপট কাজে লাগিয়ে একের পর এক অন্যায়কে বৈধতা দিয়ে বুকের ছাতি ফুঁলিয়ে বহাল তবিয়তে ছিল লোকটা।

সমাজের তথাকথিত এই লেবাসধারীর টিকিটি যে কেউ স্পর্শ করতে পারবেনা সে ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়ছিলো। তাইতো দিনে দুপুরে নুসরাত জাহান রাফির শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায় এই মানুষরূপী অমানুষ।

নিজের শিক্ষকের হাতে লাঞ্চনার শিকার নুসরাত অন্যদের মতো আত্মহননের পথ বেছে না নিয়ে প্রতিবাদ করেছে। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছে। কিন্তু মৌলভীর ভাড়াটে খুনিদের দেয়া আগুনে পুড়ে ঝলসে গিয়েছে নুসরাতের শরীরের আশি ভাগ।

মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আর পারেনি নুসরাত।

কদর্য, নোংরা এই পৃথিবীকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে নুসরাত চলে গেলো না ফেরার দেশে। কি বিভৎস করুণ মৃত্যু হয়েছে মেয়েটার।

ভালোবাসা বর্জিত অসভ্য মানুষগুলোর প্রতি মৃত্যুঞ্জয়ী নুসরাতের ব্যক্ত প্রতিবাদ আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে প্রতিবারের মতো। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদ নামক চিৎকার চেঁচামেচি মাত্র কদিনের জন্য। নতুন নতুন নুসরাতদের আত্মবলিদানে হারিয়ে যাবে পুরনো নুসরাতদের গল্প।

প্রতিটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তৈরি হয় নিত্যনতুন কাহিনী ও বিতর্ক। আস্তিক-নাস্তিক, পর্দা-বেপর্দা, নারীবাদ-পুরুষবাদ তর্কে ঢাকা পড়ে মানবতা। নারীর পর্দা ও পোশাক নিয়ে প্রশ্ন উঠে। “বেপর্দা, বেয়াড়া,বেশরম মেয়ে গুলোর এমন পরিণতি স্বাভাবিক”, বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন সুবিধাবাদি শ্রেণী।

অথচ নেকাবে মুখ ঢাকা পর্দানশীল নারী থেকে শুরু করে ফুটপাতের উলঙ্গ পাগলি কেউই দানবদের ঘৃন্য লালসা থেকে বাদ পড়েনা।

ইসলামে নারীর পর্দার পাশাপাশি পুরুষের পর্দার হুকুম রয়েছে কঠিনভাবে। পুরুষের পর্দা হবে চোখের পর্দা, যে পর্দা তার মনের পশুত্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

অপরাধীর অপরাধকে আড়াল করতে নুসরাতের হত্যাকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার বিস্তর অপচেষ্টা চলছে। বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসুত্রিতার কারণে আইনের ফোঁকর গলে বেরিয়ে যাবে সিরাজউদ্দৌলারা। আরো কত নুসরাতের কপালে যে দুর্গতি লিখা আছে তা কে জানে?

দ্রুত বিচার আইনে বিচার করা না হলে নুসরাত হত্যার বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে নিশ্চিত।

নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক বিচারহীনতার পরিবেশের সাথে আমরা মানিয়ে যাচ্ছি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ব্যর্থতার দায় মাথা পেতে নিতে আমাদের অকপট ক্ষমাপ্রার্থনা … .. “বোন ক্ষমা করে দিস”।

বোন কেন ক্ষমা করবে আমাদের?

বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কি কোন দায় নেই?

ক্ষমার অযোগ্য, অধম, কাপুরুষের দল, আমাদের বিবেকের বিচার হউক আগে।

তনু, নুসরাতদের মায়ের কান্না না থামালে আমাদেরও যে কাঁদতে হবে একদিন। তাইতো এই কান্নার কাগুজে নয় বাস্তব অবসান চাই মনেপ্রানে।

(ফারজানা ইসলাম লিনু, শিক্ষক ও গল্পকার)

Advertisement