তাদের তরে সহজ হবে মোদের বাংলা ভাষা

ফারজানা ইসলাম লিনু

তাদের তরে সহজ হবে মোদের বাংলা ভাষা

আমার বড় কন্যা সবে আছাড় বিছাড়ে অবহেলা করে হাঁটা শিখছে। তখনই আমার দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।

ছোট বাচ্চা নিয়ে একটু বাড়তি ব্যস্ততা যাচ্ছে। বড় কন্যাকে যেভাবে সময় দেয়া দরকার সেভাবে সময় দেয়া হচ্ছে না। একদিন খেয়াল করি, সদ্য কথা বলতে শেখা মেয়েটা বিচিত্র এক ভাষায় ভাব বিনিময় করছে। এমন উদ্ভট কিচিরমিচির ভাষায় আমাদের বাসার কেউ কথা বলে না।

সে ভাত খেতে চাইলে বলে, আমি ভাত খাইবাম।
গোসল করতে চাইলে বলে, আমি নাইবাম, বুড় পাড়বাম। জামাকে বলে পিরান, প্যান্টকে বলে হাফ প্যান। আরো কতো অজানা শব্দ তার ভাষার ঝুলিতে।

বিচিত্র এই ভাষার উৎপত্তিস্থল ও মর্মার্থ উদ্ধার করতে বেশি সময় লাগলো না। পারিবারিক মিটিংয়ে বাসার সবাই প্রায় একমত, আমাদের কন্যা তার মইয়ের ভাষাকে রপ্ত করছে মনেপ্রাণে। আমাদের গৃহকর্মের সহযোগী বর্ষিয়ান মহিলাকে কন্যা মই (খালা) বলে সম্বোধন করে। অতি প্রিয় সেই মইয়ের মুখের ভাষাকে কন্যা রপ্ত করছে মনে প্রাণে।

বছর দিনের ব্যবধানের দুই বাচ্চা নিয়ে আমার অথৈ জলে হাবুডুবু খাওয়ার দশা। এরমধ্যে করিৎকর্মা কন্যার
এই বিচিত্র ভাষা নিয়ে খুব বেশি আলাদা করে ভাবার সময় কই?

কন্যার প্রাণ প্রিয় মই অনেক বছর থেকে সিলেটে বসবাস করলেও ভাষাগত ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আসেনি। পরম যত্নে নিজের মত করে নিজের ভাষাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। সেই ভাষার কড়কড়ে ম্যাড়ম্যাড়ে শব্দগুলো কেউ বুঝলো কি বুঝলো না তাতে মহিলার কিছু যায় আসেনা।

আমার মেয়ের সময়টা যে খুব বেশি মইয়ের সাথে কাটতো তা কিন্তু না। দাদা দাদি ও ফুফুর সাথে তার চেয়ে বেশি সময় কাটতো। তারপরও মেয়েটা পিতৃভাষা নয়, মাতৃভাষা নয়, দাদা-দাদি, ফুফুর ভাষা নয় সে শিখছে মইয়ের ভাষা।

কোন বিষয়কে পাত্তা দিলে শিরঃপীড়া আরো বাড়ে।
তাই এই আজব বিষয় মাথা থেকে ঝেড়ে আমি কন্যাদ্বয়ের লালনপালনে আমি মনোনিবেশ করি।

কিন্তু আমার অসাবধানতার সুযোগে মেয়ের অভিধানের শব্দ ভাণ্ডার অতি দ্রুত বর্ধিত হচ্ছে। কিছু কিছু শব্দের মর্মদ্বার করতে আমাকেও বেগ পোহাতে হচ্ছে। আবার কিছু শব্দের মানেও আমার কাছে উল্টো ঠেকছে। এক দেশের গালি, আরেক দেশের বুলি”, এই কথাটাও উপেক্ষা করতে পারছি না।

স্বেচ্ছায় আত্মস্থ করা নিত্যনতুন শব্দের লাগাম টানতে এইবার আমাকে চুড়ান্ত ভাবনার ফাইল খুলে বসতে হয়েছে।
সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ , মইয়ের সঙ্গ তাকে ছাড়াতে হবে ।

কিন্তু সকাল বিকাল মই তাকে নিয়ে বাসার সামনে দুই চক্কর না মারলে গলা দিয়ে তার খাবার নামেনা। মইয়ের গলা শুনলেই তার হয়েছে। পড়ি মরি করে সে হাত লম্বা করে মই, মই করে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

হাতের শত কাজ ফেলে মইও এসে তাকে দৌড়ে কোলে নেন।

এই সঙ্গ আমি ছাড়াই কেমনে!!

তাছাড়া এই মহিলার হাতে আমার কন্যাদের বাবা ও ফুফুর শৈশব, কৈশোর ও বড়বেলা কেটেছে। এখন শুরু হয়েছে মেয়েদের পর্ব। বড় মায়াবতী সহজ সরল মহিলা।

সঙ্গ ছাড়ানোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ভাবলাম শিখুক আমার মেয়ে তার মইয়ের ভাষা। সময়মতো ঠিক হয়ে যাবে। আর ঠিক না হলেও কোন সমস্যা নেই।
মেয়ের মুখে এই ভাষা সয়ে যাবে। শুনতে শুনতে এক সময় আর তেমন মন্দ লাগবেনা, বরং দিনে দিনে মাধুর্য বাড়বে।

কিছুদিন পর খেয়াল করি ব্যক্তিভেদে মেয়েটার ভাষা প্রয়োগে ভিন্নতা এসেছে। পরিবারের সবাই একই ভাষাভাষী হওয়াতে এই জায়গায় তারতম্য বেশি ধরা পড়েনা।

কিন্তু মই আসলে তারতম্য বেশ বুঝা যায়। পিরান, পেন, খাইবাম, নাইবাম, যাইবাম, নামবাম, বুড় পাড়বাম এইসব ভাষার শ্রুতিমধুর ব্যবহার কেবল মইয়ের সাথেই হয়।

সময় পেরিয়েছে অনেক। মেয়েটা বড় হয়েছে। মইয়ের বয়সও থেমে নেই, বয়সের ভারে ন্যুব্জ অনেকটা। কপালের চামড়ার পুরু ভাঁজের নিচে মায়া মমতা আগের মত আছে। বাসায় কাজ করতে না পারলেও মহিলা আমাদের কাছাকাছি আছেন। প্রতি ঈদে পাকন পিঠা ও মাঘের মেলার তিলুয়া, বাতাসা, নকুল দানার ভাগ নিয়ে আসেন সময়মতো।

আজকেও যথারীতি এসেছেন তিলুয়া বাতাসা নিয়ে।সবার খোঁজ খবর নেয়া শেষ হলে ভাইঝিদের ঘরে উঁকি দিলেন। সেই সারল্য মাখা একখান হাসি দিয়ে বলেন, আমার ভাইঝিরা কতদ্দুরা হইছে?(কত বড় হয়েছে?)

মইয়ের কুশলাদির জবাব দিয়ে বড় ভাইঝি স্বাভাবিক ভাষায় মইয়ের সাথে কথা বলে, খোঁজ খবর নেয়। আগের সেই নাইবাম, খাইবাম, যাইবাম তার আর মনে নেই।

এক সময় যে ভাষা ভুলানোর জন্য মইয়ের সঙ্গ পর্যন্ত ছাড়াতে চেয়েছিলাম সেই ভাষাকে এই মুহুর্তে মিস করছি।মনে পড়ে গেলো কবি সুফিয়া কামালের কবিতার সেই লাইনগুলো………

মোদের দেশের সরল মানুষ
কামার কুমার জেলে চাষা
তাদের তরে সহজ হবে
মোদের বাংলা ভাষা।

মহাকালের পথ ধরে বেঁচে থাকুক আমার বাংলা ভাষা।

ফারজানা ইসলাম লিনু শিক্ষকও গল্পকার
Advertisement