বিবাহবিচ্ছেদ সন্তানের জীবনে খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে
তাজিন আহমেদ, অধ্যক্ষ, সানিডেইল স্কুল, ঢাকা।
স্কুলে শিক্ষার্থীকে একটু পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় সে কোনো সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কি না। আমাদের স্কুলে কাউন্সেলর আছেন, ফলে কোনো ছাত্রছাত্রীর মনঃকষ্টের মধ্য দিয়ে গেলে আলাদা করে ওদের সঙ্গে কথা বলা হয়। আমি নিজেও বলি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওরা কোনো কথা বলতে চায় না। কিন্তু আচরণ বা পরীক্ষার ফল হঠাৎ খারাপ হওয়া দেখলে বোঝা যায়, বাচ্চাটার কোনো সমস্যা হচ্ছে। মা-বাবার বনিবনা না হওয়া বা বিবাহবিচ্ছেদ সন্তানের জীবনে খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সন্তানের সামনে আপনারা যে ধরনের আচরণ করবেন, সন্তান আপনার অজান্তে তা শিখে ফেলবে। পরে আপনি যখন তাকে ভালো কিছু শেখাতে যাবেন, সে শিখবে না।
বিবাহবিচ্ছেদ হলে বাচ্চা রাখা নিয়ে অনেক সময় মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সন্তান যাঁর কাছেই থাকুক, আমরা মা-বাবা দুজনকে ডেকে কথা বলি। তাঁরা যেন সন্তানের সামনে এমন কোনো কথা না বলেন, যাতে সন্তান নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সন্তান জন্মদানের আগে মা-বাবার পূর্বাপর পরিস্থিতি বুঝে সন্তান নিতে হবে। সন্তানকে এত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ফেলার আগে তাঁদের ভাবনাচিন্তার দরকার।
সন্তানের চাওয়া মা-বাবাকে গুরুত্ব দিতে হবে
মাহবুবা নাসরীন, সমাজবিজ্ঞানী
সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ যে হারে বাড়ছে, সেভাবে মানসিকতার পরিবর্তন আসেনি আমাদের। আমরা মানসিকভাবে সমাজের পরিবর্তন নিতে প্রস্তুত হইনি। যে কারণে মা-বাবার সম্পর্কে কোনো সমস্যা হলে সেই পরিবারের সন্তানকে কিংবা ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানকে কেউ কেউ হেয় করে কথা বলে। এই দোষ সন্তানের নয়। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা একটু সহনশীল হলে বা সন্তানের প্রয়োজনে ছাড় দিতে হলে সন্তানের মনের কষ্ট কিছুটা কমানো যায়।
সন্তানের চাওয়া মা-বাবাকে গুরুত্ব দিতে হবে। নিজেদের মতামত সন্তানের ওপর চাপানো যাবে না। পারিবারিক সমঝোতা, পরিবারের গুরুত্ব—এগুলো সন্তানকে শেখানোর আগে মা-বাবাকে বিষয়গুলোর গুরুত্ব বুঝতে হবে। মা-বাবা ছাড়াও চারপাশের অন্যান্য মানুষ, কাছের মানুষ ও আত্মীয়দের সহনশীল হতে হবে। তাঁরা বুঝে না বুঝে মনে আঘাত দিয়ে কথা বলেন। এমন কোনো আচরণ করেন, যা সন্তানের মন ছোট করে দেয়। মা-বাবা কারও নামেই কোনো সমালোচনা সন্তানের সামনে করা উচিত নয়।
এই সন্তানদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়
হেলাল উদ্দিন আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হলে বা একই সঙ্গে থেকেও বনিবনা না হলে তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। মা-বাবা যদি সন্তানের সামনে ঝগড়া করেন বা পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকেন, তাহলে সন্তানের ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সব সময় অতি উৎকণ্ঠায় থাকে সেসব সন্তান। সন্তান যখন বড় হয়, তার ব্যক্তিজীবনেও এই প্রভাব পড়ে। তখন পরিবার গঠন করার সময় মা-বাবার আচরণের প্রতিফলন ঘটাতে পারে। যারা নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বড় হয়, দেখা যায়, তাদের আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা কম থাকে।
সন্তান জন্মদানের পর দায়িত্ববান হতে হবে। মা-বাবার আচরণ সংবেদনশীল না হলে সন্তানও অসংবেদনশীল আচরণ করবে। সেটা মাথায় রেখে দাম্পত্য জীবনে আচরণ-কথাবার্তায় সচেতন হতে হবে।
সন্তানের সামনে পরস্পরকে ছোট করা উচিত নয়
তানজীব উল আলম, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
এই ধরনের পরিস্থিতিতে সন্তানই মূলত ভিকটিম হয়ে থাকে। বিবাহবিচ্ছেদে দেখি মা-বাবা পরস্পর পরস্পরকে অনেক ছোট করে অসম্মানজনক কথা বলেন। সেটি সন্তানের মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি সন্তানের হেফাজত পাওয়ার জন্য মা-বাবা মিথ্যা কথার আশ্রয় নেন। সন্তানকেও সেগুলো শেখাতে থাকেন। যা খুবই অনুচিত। সন্তান যাঁর কাছে থাকলে ভালো থাকবে, আদালত সেই সিদ্ধান্তই নেন। যাঁর হেফাজতেই সন্তান থাকুক না কেন, সন্তানকে এটা বোঝাতে হবে মা-বাবা দুজনেই তার সঙ্গে আছে। মা-বাবা সব সন্তানের কাছে আদর্শ। পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন কোনো কথা বলা উচিত নয়, যাতে সন্তান মা বা বাবা কাউকে ভুল বোঝে।
একসঙ্গে থাকতে না পারলে সন্তানকে বলতে হবে, ‘স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমাদের আদর্শগত মিল হয়নি। তাই থাকিনি। কিন্তু তোমার পাশে থাকব।’ সন্তান যার কাছেই থাকুক, তাকে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়াটা জরুরি। এটাও ঠিক, একজনের কাছ থেকে সঠিক শিক্ষা পেয়েও সন্তান মানুষ হতে পারে। সন্তানের সঙ্গে দেখা করা নিয়েও কোনো সমস্যা করা ঠিক নয়। সন্তান যখন যাঁর সঙ্গে থাকতে চাইবে, দেখা করতে চাইবে, সেটি তাঁকে করতে দিতে হবে। মা বা বাবা যদি সন্তানকে দেখতে চান, সেটিও প্রাধান্য দিতে হবে।