ফিরে যাই শৈশবের শীতে ll

ফারজানা ইসলাম লিনু

প্রকৃতির নিয়মে তেরোই ভাদ্র শীতের জন্ম। যদিও ভাদ্রের শেষ থেকে বাতাসে শীতের গন্ধ ভেসে বেড়ায় ৷

আশ্বিনে ঘাসের ডগায় একটু একটু শিশির জমে। ভোরবেলা হালকা কুয়াশার দেখা মেলে চারপাশে। নীল আকাশে স্বচ্ছ সাদা বিদায়ী মেঘ আপনমনে শীতের গান গায়।

কার্তিকে ঝলমলে রোদের মিষ্টি কোমল পরশ দোলা দেয় প্রকৃতিতে।

ট্রাংকের তলা খোঁজে তুলে রাখা সোয়েটারটা বের করার জন্য অস্থির আমরা। শীতে সোয়েটার পরাও যে একটা উৎসব।
আম্মা পুরনো একদলা উল নিয়ে সোয়েটার, মোজা, চাদর, মাফলার বানাতে লেগে যান।

দীর্ঘ বর্ষার শেষে সবজি ক্ষেতের ঘাসের সাথে উঁকি দেয় নানা জাতের বুনো শাক। বর্ষাকালে চিনা জোঁকের কিলবিলানিতে কেউ ওদিকটা মাড়ায় না। শীতের ভয়ে জোঁক গুলো পালায়।

শীত আসতে না আসতেই সবজি ক্ষেত তৈরীতে লেগে যান হুরু দাদি। ঘাস পরিষ্কারের আগে আমাদের কাজ হলো ভাতুয়া, নুনুয়া, ক্ষুদ্রা, থানকুনি, আমরৈল শাক তোলা।

সবজির বিছরা তৈরি হয়, কার আগে কে সবজি লাগাবে সে প্রতিযোগিতাও চলে সমানে। রাই, সরিষা, পিয়াজ, ধনিয়া, সীম, লাল শাক, মুলার ছোট ক্ষেত ঘিরে সেকি আনন্দ। অংকুরিত বীজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নাইকলি বেড়া বানানোর কাজ চলে পুরোদমে।

পাজি মুরগীগুলো সপরিবারে বিছরায় হানা দে মহানন্দে। পুরো ক্ষেত তছনছ করে তাদের আনন্দের পরিসমাপ্তি ঘটে। দুষ্ট, পাজি মুরগীগুলোর নখ কেটে দেন ছোট চাচি আম্মা।

বিকেলে সবাই মিলে ক্ষেতে পানি দেই বিরাট আয়োজনে। আস্তে আস্তে শাক সবজির বীজ ফেটে চারা বের হয়। সবার আগে অংকুরিত হয় রাই আর লাল শাক। লাল- সবুজ কার্পেটের গালিচা সবার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক জাগায়।

টিনের চালে শিশির পড়ে ফোটায় ফোটায়। কাঁথা রেখে লেপ বের করা হয়। উঠানের কড়া রোদে শুকায় শিমুল তুলার নরম লেপ। নেপথালিনের ঝাঁঝালো গন্ধ নাক ছুয়ে যায়।

ভোরের শিশির পাতায় পাতায় জমে। একটু ছোয়ায় টপ করে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। শিশির ভেজা নরম ঘাসে পা ফেলে স্নিগ্ধ সকালের সুচনা। শিশির সিক্ত পায়ে পরম আদরে হাত বোলায় নরম ঘাস।

উত্তুরে বাতাসে শীত ধেয়ে আসে। সামনের পুকুরের পানিতে ঠান্ডায় পা ডুবানো যায়না। তাইতো শীতকালের জন্য দক্ষিণের পুকুর। আমরা পা বাড়াই দক্ষিণের পুকুরে। পুকুরের পাড় ছাড়িয়ে সোনা রঙের রোদ পানিতে পড়ে। রোদের আদরে পুকুরের পানি উষ্ণ হয় একটু। কচুরিপানা সরিয়ে সাঁতারের জায়গা বের করা হয়। দারকিনা মাছ দলবেঁধে কিলবিল করে । শোল মাছ ও টাকিমাছ ঠান্ডা জলে ভারিক্কি চালে লেজ নেড়ে সাঁতার কাটে

গোসলে নামলে ঘাটলার চিপা থেকে কাকড়ারা চিমটি কাটে পায়ে। ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠি। আবারো নামি পানিতে। ঝপাৎ ঝপাৎ ডুবে গোসল সারা। ঠান্ডার ভয়ে সাতার কাটা হয় না।

ইতিমধ্যে পুকুরের পানি নেমে যায় দুই তিন ঘাট নিচে। পুকুর পাড়ের নরম মাটিতে গোল গোল পুটি পাতা ও কেশুত পাতার চারা গজায়। পুটি পাতা দিয়ে হাত পা ঘষলে হাত-পা পরিষ্কার হয়, পায়ের গোড়ালি ফাটেনা। প্রাকৃতিক পেডিকিউর মেনিকিউর বিনে পয়সায় একেবারে হাতের কাছে। আমরা পুটি পাতা ঘাটলায় রেখে পা ঘষি। ঘষার চোটে গোড়ালির ত্বক লাল হয়ে যায়। প্রাকৃতিক মেনিকিউরের সফলতায় আমরা খুশিতে আটখানা ।

সরিষার তেল গায়ে মেখে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে গোসল করলে শীত তেমন গায়ে লাগেনা। তাই গোসলের আগে রোদে বসিয়ে রসুন দিয়ে জ্বাল দেয়া সরিষার তেল মর্দন চলে প্রতিদিন।

মাঠের সবুজ ধানে সবে রঙ ধরছে। কাচাপাকা ধানের বনে ঘাস ফড়িংয়ের অবাধ রাজত্ব। ধান কাটা শুরু হতে লাগবে আরো কদিন। পরিক্ষা আসন্ন তাই আব্বা তল্পিতল্পা নিয়ে হাজির। এক ঢিলে দুই পাখি। আমাদের পরিক্ষাকালীন পড়াশুনা তদারকি ও ধানতোলা।

জমে যাওয়া লক্ষীবিলাস তেলের শিশিটা উঠানের রোদে রেখে মসজিদের পুকুরে গোসল করতে যান আব্বা। স্বচ্ছ শান্ত সেই পানিতে ঝপাং ঝপাং ডুব দেন।
বাড়ি আসলে আব্বার সার্বক্ষনিক সঙ্গী আমরা দুই বোন পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে আব্বাকে দেখি।

সাদা কালো মাথা ভর্তি চুল আর ফর্সা মসৃণ বাটার সদৃশ গায়ের রঙ আব্বার। শরীরের পানি মুছে আব্বা বাড়ির উঠানে ফিরে আসেন।
রোদে দাঁড়িয়ে মাথার তালুতে ঢেলে দেন গলানো লাল রঙের লক্ষীবিলাস তেল। কতদিন হয় দেখিনা লক্ষীবিলাস তেল। মিষ্টি গন্ধটা আজও আব্বার গন্ধ হয়ে বাতাসে ভাসে। রেডি হয়ে আব্বা আবার জোহরের নামাজে। খেয়েদেয়ে শীতের দুপুরের একটু ভাত ঘুম আব্বার লাগবেই।

আসরের নামাজ পড়ে চা খেয়ে আব্বা বাজারে যাবেন। ব্যাগ নিয়ে আমি রেডি। আব্বার সাথে লামার বড়লেখা বাজারে যাব। আধা কিলোমিটার পথ হেঁটে হেঁটে যাই আমরা। পথের পাশে খেলার মাঠে বাচ্চারা হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, ছরি, বন্ধী খেলে।

গ্রামের ছোট্ট বাজার। সপ্তাহে দুদিন বা তিনদিন বসে। মাছওয়ালা সবজিওয়ালা আব্বাকে পেয়ে কুশল জিজ্ঞেস করেন। তাজা মাছ, শীতের আগাম সবজি, মুরির লাড্ডু, খই, কামরাঙ্গা, জলপাই কিনে আজমল চাচার দোকানে বসি।

আব্বা মাগরিবের নামাজ সেরে আসলে বাঁশবনের ভেতর দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা ধরে বাড়ির পথে হাঁটা দেই। মহাজন বাড়ির পরিত্যক্ত মন্দিরের পাশটা বেশি অন্ধকার। গা ছমছম করে। মসজিদে বাচ্চারা এই জায়গা নিয়ে অনেক ভয় দেখায়। আব্বার হাতটা নিজের অজান্তে চেপে ধরি।

ঘরে এসে মুরির লাড্ডু খেয়ে পড়ার টেবিলে বসা। নতুন আলু, ফুলকপি, সীম, লাউ, জিওল মাছ দিয়ে রান্না হয়। চুলা থেকে নামিয়ে আম্মা ধনেপাতা ছড়িয়ে দেন তরকারিতে। রান্নাঘরের মৌ মৌ ঘ্রান সুদূর রান্নাঘর থেকে পড়ার টেবিল পর্যন্ত গড়ায়।

রেডিওতে খবর চলছে । দেশ বিদেশের কত খবর শুনতে হয় আব্বার। ভেবে পাইনা এত খবর শুনে কি লাভ? খবর শুনা শেষ হলে আবার মসজিদে এশার নামাজে।

আব্বার সবকিছু অতিমাত্রায় সময় মাফিক। নামাজ থেকে ফিরে আসতে না আসতেই টেবিলে ভাত রেডি। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত তরকারি দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে আব্বা আবার রেডিওর খবরে। ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও বাংলাদেশের খবর শেষ হলে আস্তে করে রেডিওটা নিয়ে আসি। রোদে শুকানো গরম লেপের ভেতর শুয়ে রেডিও বেইজিং, অনুরোধের আসর শুনে বড় আরামের ঘুম।

কাঠের দোতলা ঘর ছিল আমাদের। ডাবল টিনের চালায় টুপটাপ শিশির পড়ে সারারাত। বাঁশবন থেকে থেমে থেমে হুতুম পেঁচা ডাকে। অমঙ্গলের আশংকায় আম্মা দোয়া পড়ে বুকে থু থু দেন।

ফজরের আগে ঘুম ভাঙে আম্মার। নামাজ পড়ে রাতে ভেজানো চাল পাটায় পিষে চিতল পিঠা বানান আম্মা। আমারও ঘুম ভাঙে আম্মার সাথে। সামনে পরিক্ষা। আমাদের ঘরে রাতজাগার নিয়ম নেই। লেপের ভেতর পা ঢুকিয়ে চলে পড়াশোনা চলে এই অন্ধকার ভোরে।

আব্বা নামাজ থেকে এসে গরম চা ও চিতল পিঠা খেয়ে আবারও ভয়েস অব আমেরিকা। ইকবাল বাহার ও গিয়াস কামালের ভরাট কন্ঠ জানিয়ে দেয় দেশ দশের খবর।

পড়াশোনা নিয়ে আম্মা অনেকটা নিশ্চিন্ত এখন। রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ততা বেশি।

ধান পাকতে শুরু করেছে একটু একটু করে। অগ্রহায়ণের এক তারিখ চারিদিকে ভুলাভুলি হয়।
চাল, পিয়াজ, তেল, মসল্লা, নুন চাঁদা তুলে টুফাটুফি হয়ে যায় একদফা। টুফাটুফির আয়োজন আরেকটু ভালো হয় যদি বড়শিতে আটকায় গোটা দুয়েক মাছ। ভুলাভুলির দিন চড়ুইভাতি না করলে সারা বছর না খেয়ে থাকতে হবে। তাইতো এই চড়ুইভাতি বা টুফাটুফির রেওয়াজ।
ভালো করে গোসল করে তেল দিতে হবে ভুলাভুলির দিন। নইলে সারা বছর গা শুষ্ক থাকবে।

টুফার ভাত খেয়ে কলার পাছল নিয়ে সবাই ভাবিদের ভুলা ছাড়াতে ব্যস্ত। ভাবিরা ভয়ে ধানের উগারে কাটিয়ে দেন সারা বিকেল।

“ভুলা ছাড় ভুলি ছাড় বারো মাইয়া পিছা ছাড়। ভাত খাইয়া নড়বড়। পানি খাইয়া পেট ভর।” ভুলা ছাড়ানোর ছন্দে ছড়ায় মুখরিত চারপাশ।
ভুলাভুলি নিয়ে ঝুট ঝামেলাও কম ছিলনা। অতিমাত্রায় ভুলা ছাড়াতে গিয়ে বিরাট কাইজ্যা লাগারও নজির আছে।

কদিনের ভেতর নতুন ধানের চাল চলে আসে। নতুন চাল দিয়ে ক্ষীর বানিয়ে কলাপাতা কেটে মসজিদে দেয়া হয়। প্রতিদিন কোন না বাড়ি থেকে আসতে থাকে ক্ষীর। ক্ষীরের লোভে মসজিদের পড়া কামাই হয়না তখন।

আম্মা ফজরের নামাজ পড়ে বিন্নি ভাত চুলায় চড়ান কোনদিন। এক বলোক উঠলেই পানি ঝেড়ে কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখেন। রুই,বোয়ালের পেটি ভাজিতো রাতেই রেডি হয়েছে।

কোনদিন ভাপা পিঠা হয় গরম গরম।

ছোট সবজি ক্ষেতের ক্রমবর্ধমান চারাগুলোর ঘনত্ব কমাতে বেছে বেছে তোলা হয় বাড়তি চারাগুলো। ধুয়ে কেটে ছোট মাছের ঝোলে ছেড়ে দেয়া হয় রাই সরিষার পাতা।

পুকুর পাড়ের বিছরায় পিড়ি পেতে সকালের রোদ পোহান হুরু দাদি। আশপাশের বাড়ির দাদিরা এসে আড্ডা বসান দাদির সাথে। ছোট চাচি আম্মা রান্না ঘরে বড় বেশি ব্যস্ত। তারপরও চা বানিয়ে পাঠান দাদি সমাবেশে । এলেনটি, বেলেনটি গল্পে মুখরিত দক্ষিণের পুকুর পার। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সুর্যের তেজ বাড়ে। চাদর, সোয়েটার খুলে কলা গাছে রাখেন সবাই।

পরিক্ষা প্রায় শেষ। এখন স্কুলে হাতের কাজ জমা দিতে হবে। মায়েদের সহায়তায় কেউ বা সাদা রুমালের কোনায় সুই সুতা দিয়ে ফুল তুলি, কেউবা বাঁশের বেতে রঙ লাগিয়ে হাত পাখা ও অন্যান্য জিনিস বানাই। মায়েরা বানিয়ে দিলেও এইসব দরকারি জিনিসে নাম্বার বেশি পাওয়া যায়।

আমরা মৃত্তিকার সন্তান। মাটিই আমাদের টানে বেশি। নরম এঁটেল মাটি দিয়ে তৈজসপত্র ও খেলনা বানিয়ে রোদে শুঁকাতে দেই। শক্ত হলে নাম লিখে হাতের কাজ নির্দিষ্ট তারিখে স্কুলে জমা হয়।
আমাদের চিন্তাশীলতাকে পাত্তা দেয়া হয় না একেবারে। মায়েদের বানানো খলুই, ধুছইন, হেফত, হাতপাখায় নাম্বার বেশি উঠে। কম নাম্বার পেয়ে চুপসানো চেহারা নিয়ে ফিরে এসে মায়েদের কাছে বায়না ধরি পরের পরিক্ষায় খলুই, ধুছইন, ডালা, কুলা দিতে হবে। স্কুলের দিদিমনি, আপামনি বলেছেন বে দরকারি জিনিস দিলে হাতের কাজে নাম্বার দেয়া হবেনা।

ধানতোলা প্রায় শেষ। আব্বার ঢাকা ফিরে যাবার পালা।

যাবার আগে আমাদের সাথে নিয়ে কাটা ধানের ন্যারা জমিয়ে রেখে যান। পৌষ সংক্রান্তিতে পাহাড় থেকে চুঙ্গার বাঁশ নেমে আসবে। তখন বিন্নি চাল চুঙ্গায় ভরে পোড়া দেয়া হবে।
পাশের বাড়িতে রাতে খড় ন্যারা জ্বালিয়ে আগুন পোহায় মানুষজন। লাল আগুনের লেলিহান শিখায় সবার মুখ দূর থেকে উজ্জ্বল দেখায়। দূর থেকে ওদের আগুন পোহানো দেখি। আগুন পোহানোর অনুমতি মেলেনা আমাদের।

খেলার মাঠ রেডি। দাড়িয়া বান্ধা খেলার ঘর কাটা হয়েছে। খালি হওয়া ধানি জমিতে দিগ দিগ দৌড়ে বন্ধী খেলা চলে। অন্ধকার নেমে আসার আগে ঘরে ফিরতেই হবে। একটু দেরী হলে উপায় নেই। আম্মার হুমকি, “আইজ সন্ধ্যার পরে ধরমু।” হুরু দাদির শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে মুচলেকা দিয়ে তবে রেহাই।

পৌষের রোদ মাখা স্নিগ্ধ সকাল, দুপুর, বিকেল আমার সুখের সঙ্গী। শৈত্য প্রবাহ কি জিনিস জানিনা তখন। মাঝেমাঝে সুর্য উঠতো একটু দেরীতে। এখনকার মত এত স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা ভেজা ঠান্ডা লাগতো না।

ভাড়ালে ধান ভরে স্বচ্ছল গৃহস্থ ছফিনা খতম পড়ান। সারারাত ধরে মাইক বাজিয়ে চলে ক্বারি সাহেবের কোরআন পাঠ। বিরতির সময় সুললিত কন্ঠের গজল।
ধানের খালি জমিতে বিরাট শামিয়ানা টাঙিয়ে চলে রাতভর ওয়াজ মাহফিল।

দুরের কোন গ্রামে যাত্রাদল আসে। সিরাজুদ্দৌলা বা রূপবানের যাত্রা পালা দেখে মুগ্ধ দর্শকের গায়ে শীত লাগেনা। হঠাৎ শুনা যায় কোন অভাগার ছনের ঘর পুড়ে ছাই। পুড়ে যাওয়া ঘরের বাঁশের খুটি বা চালার বাঁশ ফোটার শব্দের সাথে সর্বশান্ত অভাগা পরিবারের ক্রন্দন অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে আসে।

ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের মৌসুম ছিল এই শীতকাল। অনেক রাত অবধি মাইকে বাজে ভোটের গান। চিকা আর পোষ্টারে ঢেকে যায় ঘরের দেয়াল। মোরগ , বই, ফুটবল বা কলস মার্কা নিয়ে সরব প্রার্থীরা মা বোনদের ভোট পেতে বড়ই মরিয়া। ভোটের আতংক কম বেশি তখনো ছিল। তারপরও উৎসবের আমেজ কম ছিলনা।

মাঘে মেঘে দেখা না হলে পরের বছর ফসল ভালো হবেনা। আমের মুকুল ফুটবেনা, আমড়ার বোল বের হবে না। সবাই মিলে মাঘের মেঘের মিলনের দোয়ায় ব্যস্ত। ঝপ করে বৃষ্টি নামে অবশেষে। বৃষ্টির বাতাসে গাছের পাকা বরই পড়ে টপটপ। শুকনা পাতা সব ঝরে যায়। দীর্ঘ শীতের রুক্ষতা বিদায় নেয়, বসন্তের আগমনী আওয়াজ কানে ভাসে।

জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে আমার ছেলেবেলার শীতের গল্পতো রূপকথা ছাড়া কিছু নয়। ক’বছরের ব্যবধানে সবকিছু বড় দ্রুত হারিয়ে গেল প্রকৃতি থেকে, এমনকি জীবন থেকে।

কলাপাতা দিয়ে ঢেকে বিন্নি ভাত রান্না হয়না আর। রাইস কুকারে দিলে চট করে হয়ে যায়।
চাল কুটার শব্দে নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙেনা। ব্লেণ্ডারে করা যায় ঢেরি ঢেরি চালের গুড়া।

চুঙ্গা পোড়ার বাঁশ ঠাস ঠাস শব্দে ফুটেনা এখন। বারবিকিউ পার্টি ছাড়া যে জমেনা শীতের আয়োজন।

খড় জালিয়ে কেউ ওম নেয় না। বড্ড সেকেলে লাগে আগুন পোহানো। গ্রামের সব বাড়িতে ইলেকট্রিক হিটার চলে বেশি ঠান্ডায়।

আজও কুয়াশার চাদর ভেদ করে শীতের মায়াবী জোছনা উঠে ভরা পুর্ণিমায়। কিন্তু ধুলায় ঢাকা জোছনা বড় নিষ্প্রাণ লাগে আমার। মনে হয় হাজার বছরের পুরনো চাঁদ বড় কষ্টে জীবনের শেষ আলো ছড়াচ্ছে।

আমিতো তো পেরিয়ে আসিনি আমার শত শত বছর আগের শৈশব। মোটেতো কয়টা বছর পার করেছি।

হাতে যদি আসে কভু একটা টাইম মেশিন ফিরে পেতে চাইবো সেই শিশুকালের শীত।

আশ্চর্য জাদুর আংটির ঘষায় যদি নেমে আসে আলাদিনের সেই দৈত্য। হুংকার ছেড়ে যদি জানতে চায়, কি চাই জাহাপনা?
ফিরে চাইবো আমার শৈশব, শীতের শৈশব।

ফারজানা লিনু(গল্পকার ও শিক্ষক)

Advertisement