ছিটমহলবাসীর চোখ বেয়ে বহুবার জল গড়াতে দেখেছি। একই মানুষ, একই চোখ, একই রঙের জল ভিন্ন ভিন্ন আবেগে গড়িয়েছে তাঁদের চোখে। তাঁদের পরাধীন জীবনের যন্ত্রণাকাতর করুণ ছবি এখনো চোখের সামনে ভাসে। করুণ আর্তির শব্দ এখনো কানে বাজে। যখন শুনি সেই মানুষেরা সুখে আছেন, শান্তিতে আছেন, তখন বুক ভরে যায়। সময়-সভ্যতা-মানবতা যেন অসহায় ছিটমহলবাসীর জীবনে বিজয়কেতন উড়িয়েছে।
২১ জুলাই কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়া বিলুপ্ত ছিটমহলে গিয়েছিলাম। নীলকমল নদের পাশে হাবিবপুর গ্রামে একটি বাড়ির উঠানে অনেকেই বসে গল্প করছিলেন। সেখানে ষাটোর্ধ্ব জাবেদ হোসেন বলছিলেন,Ñ‘আমার ছেলের সরকারি চাকরি হইচে, সরকারি চাকরি!’ এ কথাগুলো যখন তিনি বলছিলেন, তখন দেখলাম তাঁর চোখের কোনায় জল।
এই জাবেদ হোসেনের চোখ বেয়ে কতবার জল গড়িয়েছে, তার অন্ত নেই। জন্মের পর থেকে তিনি থেকেছেন পরাধীন। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করেছে, ব্রিটিশ বিদায় হয়েছে; ছিটমহলবাসীর স্বাধীনতা আসেনি। সেদিনের পরাধীনতায় চোখে জল, এই দিনের স্বাধীনতায় এবার ছেলের বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী—বিজিবিতে চাকরির কথায় চোখে জল। পরাধীনতার দীর্ঘ চোখের জল মুছে গেছে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে। সেই রাতে জাবেদ হোসেন বলেছিলেন, ‘হামার আর কোনো কষ্ট নাই। দেশ পাছি, সোগ কষ্ট ভুলি গেছি।’
দাসিয়ারছড়ার কালীর হাটে অনেক লোকের সমাগম। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির কার্যালয় সেখানেই। এখনো পুরোনো একটি সাইনবোর্ড আছে। কার্যালয়ের ভেতরে কয়েক বছর আগের আন্দোলনের সময়কার কয়েকটি ব্যানার এখনো ঝুলছে। ব্যানারগুলোর ভাষাতেও যেন সেই পরাধীনতার গন্ধ লেগে আছে। কার্যালয়ের সামনেই দাঁড়ানো আলাউদ্দীন। তিনি ছিলেন ভারতীয় অংশে। তবু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে। বিজয়ের সূর্য উঠেছে। বাঙালি জাতির উৎসবে তিনিও শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের জীবনের পরাধীনতা তখনো দূর হয়নি। তিনি সেই স্বাধীন দেশের নাগরিক হলেন ২০১৫ সালে। তাঁর ছেলে এখন বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগে চাকরি পেয়েছে। যখন আলাউদ্দীন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তাঁর বুক যেন আকাশের মতো বড় হয়ে উঠেছিল, ‘যুদ্ধ করছি, দেশ আনছি, সেই দেশের এখন নাগরিক। ছেলে সরকারি চাকরি করে। জীবনে আর কী চাই!’ পাশেই ছিলেন দোকানদার লুৎফর রহমান। তাঁরও বুকটা যেন গর্বে ফুলে উঠল। যোগ করলেন, ‘হামার ব্যাটারও চাকরি হইচে এ বছর। বিজিবিত আছে। ছিট স্বাধীন না হইলে কোনো দিন ব্যাটার চাকরি হইল না হয়।’
ছিটমহলবাসীর স্বাধীনতার জন্য অনেক দিন আন্দোলন করেছেন রফিকুল ইসলাম। ছিটমহল স্বাধীন হওয়ার আগে কেমন ছিলেন, এখন কেমন আছেন, এ কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন,Ñ‘সারা জীবন যদি কলম দিয়ে লেখি যান, কালি শ্যাষ হইবে, কাগজ শ্যাষ হইবে, তবু আনন্দের কথা কয়া শ্যাষ করা যাবার নয়। এখন বুঝি জীবন কত সুন্দর! আগোত বুঝি নাই।’
দীপ্তিমান স্টাডি হোম ও দীপক সেন সরণি
তিন বছর আগে যখন ছিটমহলগুলো ঘুরতাম, তখন খুব কষ্ট হতো। সড়ক ছিল কাঁচা-ভাঙা। ৬৮ বছরের ভাঙা সড়ক। সেই সড়ক এখন পিচঢালা। সেখানে গেলে এখন আর কারও ম্লান মুখ চোখে পড়ে না। প্রতিটি বাড়িতেই বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া। মাত্র তিন বছরে বদলে গেছে দাসিয়ার ছড়া ছিটমহলের চিত্র। সেখানে দৃষ্টিনন্দন একটি শহীদ মিনারও চোখে পড়ল। মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশান, স্কুলসহ অনেক কিছুই হয়েছে।
কামালপুর বটতলায় পাকা সড়কের পাশেই একটি বাড়িতে দেখি লেখা ‘নতুন বাংলা দীপ্তিমান স্টাডি হোম’। কালীর হাটের মোড়ের সড়কে লেখা দীপক সেন সরণি। দীপক সেনগুপ্ত এবং দীপ্তিমান সেনগুপ্ত—এ দুজন মানুষ ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। তাঁদের সম্পর্ক পিতা-পুত্র। ১৯৯৪ সালে ছিটমহলবাসীর মুক্তির আন্দোলন শুরু করেছিলেন দীপক সেনগুপ্ত। তিনি যখন খুব অসুস্থ হন, তখন নিজের ছেলে দীপ্তিমান সেনগুপ্তের কাঁধে দায়িত্ব দেন আন্দোলন করার। পিতার মৃত্যুর পর ছেলে বড় চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন বাবার অসমাপ্ত কাজ। তারই ধারাবাহিকতায় আসে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট। দীপক সেনগুপ্তের স্ত্রী, দীপ্তিমান সেনগুপ্তের মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ভারতের কোচবিহারে, তাঁদের দিনহাটার বাড়িতে। সে সময় তিনি বলছিলেন, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের বাড়িতে প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র রাখতেন। ছিটমহল আন্দোলনের সাফল্য তাঁর চোখেও পানি এনে দিয়েছে। তাঁদের স্মরণ করা বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।
ছিটমহল অন্তপ্রাণ সংগঠক গোলাম মোস্তফা এবং মইনুল ইসলাম। তাঁরা ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটিতে বাংলাদেশ অংশে নেতৃত্ব দেন। নিজ নিজ পরিবারের সব কাজ ফেলে ছিটমহলবাসীর দুর্দিনে এ দুজন মানুষ পাশে ছিলেন। ছিটমহলবাসী গোলাম মোস্তফার বাবাকে অকারণে জেলও খাটতে হয়েছিল। আন্দোলনের জন্য এ দুজনকে পুলিশ বন্দী করেছিল। কোনো ভয়ই তাঁদের আন্দোলন থেকে ফেরাতে পারেনি। পঞ্চগড়ে একটানা ২৭ দিন অনশন করেছিলেন। স্লোগান ছিল ‘হয় মুক্তি, নয় মৃত্যু’। এমনও হয়েছে পঞ্চগড়ে ছিটমহলবাসীর ঘরে আগুন দিয়েছে শুনে এ দুজন মানুষ শীতের রাতে মোটরসাইকেলে ২০০ কিলোমিটার চলেছেন একসঙ্গে। কুড়িগ্রাম থেকে পঞ্চগড়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব তুচ্ছ করে তাঁরা আন্দোলন করেছেন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে তাঁরা ছিটমহলবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে গড়ে তুলেছেন।
২১ জুলাই ছিটমহলে গিয়ে দেখলাম, গোলাম মোস্তফা ১ আগস্ট স্বাধীনতার তিন বছর উদ্যাপনের প্রস্তুতিসভার কাজ করছেন। মইনুল ইসলাম বলেছিলেন ‘ছিটমহলবাসীর কষ্ট সহ্য করতে না পেরেই তাদের জন্য ২১ বছর আন্দোলন করেছি।’
২০১৫ সালের পর থেকে নিজ দেশে পরাধীন থাকার গ্লানি আর ছিটমহলবাসীকে সহ্য করতে হয় না। নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে আর অন্যকে বাবা পরিচয় দিতে হয় না। শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তাসহ দেশের সব সুযোগ-সুবিধায় এখন তাদেরও সমান অধিকার। ২৪ জুলাই ফের গিয়েছিলাম সেখানে। দাসিয়ারছড়ার দোলাটারী পাড়ায় দেখা গেল, অনেকে এসেছেন ছিটমহলবাসীর স্বাধীনতার তিন বছর পূর্তি উৎসবের আলোচনা করতে। বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ অনেকেই তাঁদের পরিবর্তিত জীবনের কথা শোনালেন। প্রতি মাসে তাঁরা ৩০ কেজি চাল পান। প্রায় সব বয়স্ক ব্যক্তি, বিধবা ও প্রতিবন্ধীরা পান ভাতা। দল বেঁধে নারীরা সেলাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী বলছে, Ñঠিকানা পরিবর্তন করে মিথ্যা ঠিকানা দিয়ে এখন আর তাদের স্কুলে যেতে হয় না। পথে ঘুরতে ঘুরতে হরহামেশাই দেখা মিলল খুদে পড়ুয়াদের। ছেলেশিশু তো বটেই, অনেক মেয়েও সাইকেল হাঁকিয়ে ছুটছে বিদ্যালয়ে। এই তো স্বাধীনতা!
লেখক: ছিটমহল বিনিময়বিষয়ক গবেষক এবং সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর