বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ”

:ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী:

“বঙ্গবন্ধু” অর্থাৎ বাংলার বন্ধু, শব্দটির সাথে ১৬ কোটি মানুষ বহুল ভাবে পরিচিত।তবে সত্যিকার অর্থে উনি কে? উনি কি শুধুই শেখ মুজিবুর রহমান একজন ব্যক্তি বিশেষ? নাকি অন্য কিছু? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের কে যেতে হবে অনেক অনেক পেছনে।

বাঙালি এমন এক জাতি যাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় দুই বার। আমি দুইবার এজন্য বলছি ব্রিটিশ বিরুধী আন্দোলনে আমরা লড়াই করে ইংলিশদের বিতাড়িত করে স্বাধীনতা অর্জন করি একবার আর যার ফলে গঠিত হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। আর এই সংগ্রামে বাঙালিদের বীরত্ত্ব গাঁথা ইতিহাসকে যেমন সমৃদ্ব করেছে ঠিক তেমনি তাদের আত্মদান স্বাধীনতার পথকে করেছে সুগম। কিন্তু কেউ কি তখন মনে করেছিল আমাদেরকেই আবার স্বজাতির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে? ক্ষুধিরাম, প্রীতিলতা কিংবা সূর্যসেনরা যেমন উপলব্দি করতে পারেননি, ঠিক তেমনি পারেননি আমাদের তখনকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ১৫০০ মাইল দূরত্ব আর সম্পূর্ণ ভিন্ন কৃষ্টি আর কালচারের ফারাক নিয়ে শুধুমাত্র ধর্মীয় আবেগের উপর রাষ্ট্র গঠন যে কত অবৈজ্ঞানিক ছিল তা ১৯৪৭ সালের দেশ গঠনের পরই মানুষ অনুধাবন করতে পারে। স্বাধীকারের স্লোগান দিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন রূপ নেয় স্বায়ত্ব শাসনে আর যার পরিসমাপ্তি হয় স্বাধীনতায়। ১৯৫২ – ১৯৭১ সালের এই ধাপে ধাপে রূপ বদল কিংবা জনগণকে ঐক্যবদ্ব করে আন্দোলনকে সফল ভাবে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার পেছনে রয়েছে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু।

তাই বঙ্গবন্ধু কোন ব্যক্তি নন বরং একটি প্রতিষ্টান। তিনি ছিলেন সময়ের একজন সাহসী নেতা।পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ঘোষ্ঠীর শোষণে জর্জরিত হয়ে যখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দিশেহারা ছিল। ঠিক তখন মানুষের মনের ভাষা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আর তাই তিনি ছিলেন গণ মানুষের নেতা. ৫২ থেকে ৭১ ধাপে ধাপে তৈরি করেছিলেন বাঙালির মুক্তির সনদ “স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ”।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এক চরম বিস্ময়ের। এখনকার মতো তখন সোশ্যাল মিডিয়া, রেডিও, খবরের কাগজ, টেলিভিশন ছিলোনা। মিডিয়া বলতে যা কিছু ছিল সব সরকারের নিয়ন্ত্রণে।

মানুষ ও এখনকার মতো সচেতন ছিলনা। সমাজ ও ছিল অনেক পশ্চাদপদ। কিন্তু এই শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এই ঘুমন্ত জাতিকে উনি কিভাবে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। তার মধ্যে এক অসাধারণ গুণাবলী ছিল আর যার জন্য তিনি সাধারণ পশ্চাদপদ জাতিকে একতাবদ্ব করে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন আর এখানেই তার রাজনীতির সবচেয়ে বড়ো সফলতা।

তবে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচার রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো – বঙ্গবন্ধুর নাকি স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি বরং চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হতে। প্রশ্ন হলো এই অভিযোগের ভিত্তি কি? এবং এর সত্যতা কতটুকু? ইতিহাস ঘটলে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় করা। যার যাত্রা শুরু ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এখানে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্টায় বঙ্গবন্ধুর সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি সশস্ত্র বিপ্লব আর অন্যটি গণতান্ত্রিক পদ্বতিতে অধিকার প্রতিষ্টা।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজীবন গণতন্ত্রের লড়াকু সৈনিক। উনি সশস্ত্র বিপ্লবের নেতা ছিলেননা। উনি বিশ্বাস করতেন জনগণকে নিয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের শাসন প্রতিষ্টা করা। আর ৭০ এর নির্বাচনে অংশ গ্রহণ তারই ইঙ্গিত বহন করে। এই নির্বাচনে অংশ গ্রহনের উদ্দেশ্য ছিল, জনগণের মেন্ডেট নিয়ে শাসন ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের শাসন প্রতিষ্টা করা। আর জনগণের শাসন কি হবে তা ছিলো মানুষের কাছে পরিষ্কার। ১৯৬৬ সালের প্রণীত ৬ দফা আন্দোলন যা ছিলো বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। যা পরে বর্ধিত করে রূপ নেয় ১১ দফায়। ৭০ এর নির্বাচনের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো ১১ দফা। এ নির্বাচনে পাকিস্তানের মোট ৩০০ টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আলীগ ১৬০ টি আসন জয় লাভ করে একক এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যা ঘরিষ্টতা অর্জন করে আর অপরদিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান পিপুলস পার্টি জয় লাভ করে মোট ৮০ টি আসনে। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক ভাবে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করলে মানুষের প্রাণের দাবি ১১ দফা বাস্তবায়ন ছিলো সময়ের ব্যাপার। সুতরাং সরকার গঠন করা তার ব্যক্তিগত কোন অভিপ্রায় নয় বরং ছিলো একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।

নির্বাচনে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে শাসন ক্ষমতা না পাওয়া অথবা নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে যেতে সহায়তা করে। ৭০ এর নির্বাচনের ফল বঙ্গবন্ধুকে কিংবা নির্বাচিত দল আলীগকে অথবা সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ব করেছিল চূড়ান্ত লক্ষ্যে যেতে। তাই ৭০ এর নির্বাচনের ফল, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নৈতিক, রাজনৈতিক এবং এবং সর্বোপরি সাংবিধানিক ভিত্তি মজবুত করে।

আর যদি বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক কিংবা শাসনতান্ত্রিক পদ্বতি অনুসরণ না করে সশস্ত্র সংগ্রাম করতেন, তবে সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্বে পশ্চিম পাকিস্তান আগরতলা ষড়যন্ত্রের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা দেশদ্রোহীতার অভিযোগ দিতো আর আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যেত অনেক আগেই। তাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল খুব সুদূর প্রসারী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্বি সম্পন্ন। এমনকি ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যে রাতে পাক বাহিনি যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তখন বঙ্গবন্ধুকে পালানোর জন্য প্রচুর চাপ ছিল। আর যারা চাপ দিচ্ছিলেন তাদের ধারণা ছিলো বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাটা পড়বে। বঙ্গবন্ধু কিন্তু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন তার গ্রেফতার প্রকারন্তরে সংগ্রামকে আরো বেগবান করবে, পরে তা প্রমাণিত ও হয়। আর তাই মৃত্যু অবধারিত জেনেও তিনি গ্রেফতার হতে কুন্টা বোধ করেননি। যদি তিনি সেদিন ভয়ে পালিয়ে যেতেন তাহলে হয়তো তাকে নয় মাস জেলের গ্লানি টানতে হতোনা কিন্তু বাঙালিদের নাম সেদিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খাতার তালিকায় চলে যেত। সুতরাং এই অভিযোগ শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার জন্য নয় বরং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে কালিমা লেপন করার জন্যই করা হয়।

আর তাই যুগে যুগে বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের ইতিহাসকে ভিন্ন ভাবে প্রবাহিত করতে পরিকল্পিত ভাবে অপপ্রচার গুলো করা হয়। মেজর জিয়াকে বলা হয় “স্বাধীনতার ঘোষক”। শুধু তাই নয় স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরে মেজর জিয়ার ছেলে তারেক রহমান হটাৎ করে ঘোষণা দিয়ে বসলেন তার বাবা নাকি বাংলাদেশের “প্রথম রাষ্ট্রপতি”। জানিনা স্বাধীনতার ইতিহাস তিনি কতটুকুইবা জানেন অথবা বুঝেন।

ইতিহাস বলে ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চের আগে বাঙালি জাতি মেজর জিয়া কে – তা জানার সৌভাগ্যটুকুই হয়নি। ২৫ শে মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর, আর ঠিক তখন গ্রেফতার হবার পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তখনই শুরু হয়েছিল মুক্তি সংগ্রামের। আর ২৭ শে মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর পর বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা পাঠ করেন মেজর জিয়া। এখানে যদি স্বাধীনতা যুদ্বের ডাক দেয়ার যোগ্যতা বিশ্লেষণ করা হয়। তাহলে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ছিলেন উপযুক্ত ব্যক্তি, দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির সেই অবস্থান ছিলোনা। সেটা রাজনৈতিক ভাবেই হোক কিংবা আইনগত দিক দিয়ে হোক, বঙ্গবন্ধুই ছিলেন অদ্বিতীয়।

বলা বাহুল্য ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ও ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা। কার্যত ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তান চলছিলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। তখন শুরু হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলন। জিয়াউর রহমানের তখন কোন অস্তিত্বই ছিলোনা। তাহলে কিভাবে এবং কোন আঙ্গিকে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উপাধিদেয় তা একমাত্ৰ তারাই জানেন।

ঠিক তদ্রুপ ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল গঠিত মুজিব নগর প্রবাসী সরকারের সুবাধে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর তার অবর্তমানে অস্থয়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এই সরকারের যেমন রাজনৈতিক বৈধতা ছিল তেমনি ছিল আইনগত। কেননা বঙ্গবন্ধুই ছিলেন পূর্বপাকিস্তানের একমাত্র নির্বাচিত নেতা এবং নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের প্রধান। তাকেই ঘিরে তখন সমস্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় পৃথিবীতে যত গুলো অস্থায়ী কিংবা প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছে তারমধ্যে এই সরকার ছিল একটু ব্যতিক্রম। কারণ এই সরকার ছিল জনগণের সরাসরি ভোটের প্রতিফলন। তাই সরকারের রাজনৈতিক ও আইনগত বৈধতার পূর্ণতা ছিল। তাই আবারো প্রশ্ন জাগে কিভাবে এবং কোন অযুহাতে তারা চারদশক পর যুক্তি দেয় বঙ্গুবন্ধু নয় জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তারা ভুলে যায় জোর জবরদস্তি করে আর যাই হোক নেতা বানানো যায়না। তাই এই দাবি আমাদের স্বাধীনতা ইতিহাসের বিরুদ্বে একটা পরিষ্কার ষড়যন্ত্র, যার যাত্রা শুরু স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই ১৯৭৫ সাল থেকে, জানিনা এর শেষ কোথায়। তবে একটি কথা নির্ধিদায় বলা যায় বঙ্গবন্ধুকে কখনোই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবেনা। কারণ বঙ্গবঙ্গু মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে বঙ্গবন্ধু ও ঠিক ততদিন বেঁচে থাকবেন।

লেখক: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী।

তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক, যুক্তরাজ্য আলীগ

ACB#17

Advertisement