শুনেছি আপনি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় একটা অ্যান্টি-ভাইরাস সফটওয়্যার তৈরি করেছিলেন। অতএব আমরা বোধ হয় ছেলেবেলা থেকে শুরু করতে পারি।
আমি প্রোগ্রামিং শুরু করেছি ক্লাস থ্রি থেকে। খুব ছোটবেলায় আব্বু কম্পিউটার কিনে দিয়েছিল। তখন সম্ভবত ১৯৮৫ সাল। কোনো ডিস্ক ড্রাইভ ছিল না। মেমোরি ছিল ৬৪ কিলোবাইট। ধরুন একটা গেম খেলবেন, আধা ঘণ্টা বসে থাকতে হতো গেম লোড হওয়ার জন্য। আব্বু আমাকে কম্পিউটারের ম্যানুয়াল ধরিয়ে দিল। সেখানে প্রোগ্রামিং সম্পর্কে কিছুটা প্রাথমিক ধারণা ছিল। সেই ম্যানুয়াল দেখেই প্রোগ্রামিংয়ের হাতেখড়ি। আমার ছোট ভাই গেম খেলতে চাইত, ওর খেলার মতো কোনো গেম ছিল না। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়ই ছোট ভাইয়ের জন্য আমি খুব সাধারণ, ছোট ছোট গেম বানানো শুরু করলাম।
এখন যেমন গুগল করে কিংবা ইউটিউব দেখে শেখা যায়, সেই সময় তো আর এই সুযোগ ছিল না…
না। নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোই ছিল ভরসা। ওরা মাঝেমধ্যে কম্পিউটারের বই আনত। আমার শখই ছিল টাকা জমিয়ে এসব বই কেনা। তখন কম্পিউটারের ভাইরাস নিয়ে খুব কথা হচ্ছে, আমার কাছে মজার লাগত। সম্ভবত ক্লাস এইটে পড়ার সময়, ঢাকা ভাইরাস নামে একটা ভাইরাস ছড়াল। ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম, ভাইরাস কীভাবে কাজ করে। তখনই প্রথম অ্যান্টি-ভাইরাস তৈরি করি। নাম দিই মুনিরস ভাইরাস কিলার, এমভিকে। ক্লাসের বন্ধুদের কেউ কেউ আমাকে ভাইরাস ডাকা শুরু করল। আমার আসলে বাইরের দুনিয়ায় কোথায় কী হচ্ছে, এসব নিয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। আমি আমার দুনিয়ায় ডুবে থাকতাম। বন্ধুরা খেলত, আমি কম্পিউটারের বই পড়তাম। মাইক্রোল্যান্ড কম্পিউটার অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইনস্টিটিউট নামে আব্বুর একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। সেখানে আমি ক্লাস নিতাম। আমি পড়তাম স্কুলে, কিন্তু আমার স্টুডেন্টরা বেশির ভাগই তখন চাকরি করত। এটা একটা মজার অভিজ্ঞতা। শেখাতে শেখাতেই আমি শিখেছি।
স্কুল-কলেজে তো বোধ হয় তখনো ‘কম্পিউটার’ নামে আলাদা কোনো বিষয় ছিল না?
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছিল। আমি পড়েছি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল আর নটর ডেম কলেজ। মজার ব্যাপার হলো, বাংলা মিডিয়ামের স্টুডেন্ট হয়েও মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমিকের পাশাপাশি আমি এ লেভেল-ও লেভেলের দুটো বিষয় নিয়েছিলাম। গণিত আর কম্পিউটার। শুধু আগ্রহ থেকেই পড়েছি। কলেজে উঠে আমি ও লেভেলের ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার পড়াতাম।
এম রিকভারি নামে আপনি একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছিলেন…
হ্যাঁ। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ি। ১৯৯৯ সালের ২৬ এপ্রিল সারা পৃথিবীতে চেরনোবিল বা সিআইএইচ নামে একটা কম্পিউটার ভাইরাস আঘাত করেছিল। এটা কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ও মাদারবোর্ডের বায়োসের তথ্য মুছে ফেলে। তখন আমি একটা সফটওয়্যার বানাই ‘এম রিকভারি’ নামে, অর্থাৎ মুনিরস রিকভারি। মুছে যাওয়া অংশটুকু এম রিকভারি দিয়ে আবার ফিরিয়ে আনা যায়। আব্বুকে আমি বলেছিলাম, এই সফটওয়্যারটা আমি ‘ফ্রি’ করতে চাই, যে কেউ যেন এটা ব্যবহার করতে পারে। খবর পেয়ে রয়টার্স থেকে সাংবাদিক আমার সাক্ষাৎকার নিতে এল। আমি বলে দিলাম, অমুক ওয়েবসাইটে এটা ফ্রি পাওয়া যাবে। অনেকেই এটা ব্যবহার করতে শুরু করল। মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের একটা নামি সফটওয়্যার কোম্পানি তখন দাবি করেছিল, আমার সফটওয়্যারটা ক্ষতিকর। আসলে ওরা এত টাকা দিয়ে যেই সফটওয়্যার বিক্রি করছে, কোথাকার কোন এক বাচ্চা ছেলে সেটা ফ্রি দিয়ে দিচ্ছে, এটা ওরা পছন্দ করেনি।
আপনি যেহেতু তখনো ব্যাপারগুলো নিয়ে তত সিরিয়াস ছিলেন না, নিশ্চয়ই মজাই পেয়েছেন।
হ্যাঁ। আমার কাছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অনেক ই-মেইল আসত। যারা এম রিকভারি ব্যবহার করে সুফল পেয়েছে, তারা ই-মেইলে ধন্যবাদ জানাত। মনে আছে, এক বাবা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ই-মেইল করেছিলেন। তাঁর ছেলের সব ছবি ছিল কম্পিউটারে। সেগুলো মুছে যাওয়ায় এম রিকভারি দিয়ে সে ছবিগুলো উদ্ধার করেছে। অবসর সময়ে ই-মেইলগুলো পড়তাম। আমার বানানো সফটওয়্যার মানুষের কাজে আসছে, ভাবতেই ভালো লাগত।
গুগল আপনাকে খুঁজে পেল কীভাবে?
অনার্স, মাস্টার্সে আমার রেজাল্ট বেশ ভালো ছিল। এরপর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলাম কম্পিউটার বিজ্ঞানে মাস্টার্স করতে। সেখানে গিয়ে বুঝলাম, আমরা আসলে কত কম জানি! জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার সিকিউরিটিতে পিএইচডি করার পর ভেবেছিলাম দেশে ফিরব। তখন দেখলাম আমার বন্ধুরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে গেছে। আমি যদি দেশে ফিরে শিক্ষকতা করি, আমাকে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আমার অনেকগুলো গবেষণাপত্র ছিল। যদি আরও গবেষণার কাজ করতে চাই, দেশে হয়তো সেই সুযোগ পাব না। গুগল, ইনটেলসহ বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠান থেকে অফার পেয়েছিলাম। ২০১০ সাল। আমি গুগলেই কাজ শুরু করলাম। আমার পিএইচডির বিষয়টা দেখে ওরা আগ্রহী হয়েছে।
এখন আপনার কাজটা কী?
আমার পদবি হলো স্টাফ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ২০১৫ সাল থেকে আমি গুগলের টেক লিড ম্যানেজারের দায়িত্বে আছি। টেক লিড ম্যানেজারের কাজ হলো বিভিন্ন প্রকল্প ও দলের নেতৃত্ব দেওয়া। আমার দলে যাঁরা আছেন, সবাই পিএইচডি করা সফটওয়্যার প্রকৌশলী। আমাদের ‘সেফ ব্রাউজিং’ টিমের কাজ মূলত ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রাইভেসি’ নিয়ে। পৃথিবীতে যত মানুষ গুগল ব্যবহার করেন, হতে পারে সার্চ করছেন, ব্রাউজ করছেন বা অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করছেন; আমাদের কাজ হলো ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা দেওয়া। আমরা কিছু অটোমেটেড (স্বয়ংক্রিয়) সিস্টেম বানাই। ইন্টারনেটের যেসব জিনিস ব্যবহারকারীদের ক্ষতি করতে পারে, সেগুলো চিহ্নিত করি। আমার টিম মূলত অ্যান্ড্রয়েডের অ্যাপগুলো বিশ্লেষণ করে। গুগল প্লেতে যত অ্যাপ প্রতিদিন আপ হচ্ছে, আমাদের সিস্টেম সেটা স্ক্যান করে। ক্ষতিকর কিছু পেলে ব্লক করে দেয়। এই নিরাপত্তা না দিলে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হতে পারে, ফোনের মাধ্যমে কেউ ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নিতে পারে…
তার মানে এখন আপনি যে কাজটা করেন, সেটাও ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার মতো। হয়তো এখন আর ই-মেইল আসে না, তবু…
হ্যাঁ, বলতে পারেন। আমার ভালো লাগাটা আসলে এখানেই। আমি এমন একটা কিছু করছি, যাতে মানুষ উপকৃত হচ্ছে। আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি। প্রকৌশলে পড়ার সময় অনেকে দেখে এখন কোন জিনিসটার চাহিদা বেশি, কোন চাকরির বাজার ভালো। হ্যাঁ, চাকরি অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু কখনো কখনো চাহিদার চেয়ে বড় হলো আগ্রহ। দুটো ব্যাপার বিবেচনা করা উচিত। কোন দিকটাতে আমার আগ্রহ আছে এবং কোন কাজের মাধ্যমে আমি মানুষের উপকার করতে পারি।
আপনি কিন্তু একদম সুন্দর পিচাইয়ের (গুগলের প্রধান নির্বাহী) সুরে কথা বললেন! তাঁর বক্তৃতায় শুনেছি, তিনিও ঠিক এ কথাই বলেন।
তাহলে তো খুবই ভালো! যেকোনো প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ আসলে লিডারের ওপর নির্ভর করে। এর আগে ল্যারি, সার্গেই যখন ছিলেন, তাঁরা একটা বুদ্ধিদীপ্ত, বিনয়ী পরিবেশ গড়ে তুলেছেন। সুন্দর পিচাই সেটাকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। আমার সৌভাগ্য যে বিশ্বের সেরা মানুষদের সঙ্গে কাজ করছি। ২০১০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত, কখনোই আমি ‘আনচ্যালেঞ্জড’ অনুভব করিনি। সব সময় আমার সামনে কোনো না-কোনো চ্যালেঞ্জ আছে। আপনি যখন সব বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে কাজ করবেন, তখন আপনার লক্ষ্যই থাকবে কীভাবে নিজেকে আরও উন্নত করা যায়।
বাংলাদেশের তরুণেরা কীভাবে নিজেদের আরও উন্নত করবে? আপনার কী মনে হয়?
এখন অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমি শুনেছি বাংলাদেশে অনেক সফটওয়্যার তৈরি হচ্ছে, বাইরে থেকে কাজ আসছে। কিন্তু দেখেন, একটা ব্যাপার কী, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে আমি দেখেছি, তারা ছোট পরিসরে কাজ করে না। তারা অনেক বেশি ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছাতে চায়। আমাদের লক্ষ্যও মাঝেমধ্যে সারা বিশ্ব হওয়া উচিত। হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদের নিজেদের জন্যও সফটওয়্যার বানাতে হবে। কিন্তু আমরা এমন সফটওয়্যারও বানাব, যেটা সারা পৃথিবীর মানুষের কোনো একটা সমস্যা সমাধান করবে। এখন সহজে একটা অ্যাপ বানিয়ে সেটা গুগল প্লেস্টোর কিংবা অ্যাপলে আইওএসে দিয়ে দেওয়া যায়। বাংলাদেশে এখন খুব ভালো একটা সময়। উদ্যোক্তারা কাজ করছে, প্রচুর উদ্ভাবন হচ্ছে। আমাদের দেশে মানুষ অনেক, আমাদের মেধা খুব ভালো। কিন্তু এই জনসংখ্যা আর মেধাটা জায়গামতো কাজে লাগাতে হবে।
এই সাক্ষাৎকার যেদিন ছাপা হবে, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। আপনার বাবা ড. রফিকুল ইসলাম শরীফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আপনি অল্প কয়েক দিনের জন্য দেশে এসেছেন, এর মধ্যেও গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। নিশ্চয়ই আপনার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় প্রভাব আছে।
আমার জীবনের সবচেয়ে মজার সময়টা কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, একজন আরেকজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সম্ভবত…একজন আরেকজনকে সাহায্য করে। আমাদের সময় ডিপার্টমেন্ট ছোট ছিল। কিন্তু আমার সেই সময়ের বন্ধুরা এখন প্রত্যেকে ভালো অবস্থানে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। সবার সঙ্গে সম্পর্কটা এখনো আগের মতোই আছে। এবার সময় খুব কম। আসলে এত ব্যস্ত থাকি। অল্প সময়ের জন্য এসেছি, তাও আমাকে তিন মাসের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হয়েছে। তো বন্ধুরা বলল, এরপর যদি একটু সময় নিয়ে আসি, হয়তো কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে কিছু সেমিনার করতে পারি। বাইরে থেকে কিছু ভার্চ্যুয়াল ক্লাস নেওয়ার চিন্তাভাবনাও আছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা আছে। প্রবাসে আরও যারা আছে, আমি তাঁদের সঙ্গেও কথা বলব। ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যদি আমাদের অভিজ্ঞতাটা ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়, আশা করি সেটা কাজে আসবে।