মহান মে দিবস ! শ্রমজীবীদের আত্মত্যাগের এক বিরল ইতিহাস

:নজরুল ইসলাম:

বাংলাদেশে সরকারের গৃহীত কর্মসূচী ও এর সুষম ব্যবস্থাপনার মধ্যেই বিশ্ব শ্রমজীবীদের ঐতিহাসিক বিপ্লব ও আত্মত্যাগের প্রতিফলন দেশে ঘটানো সম্ভব।

মহান মে দিবসের ইতিহাস সেই একই, যাহা ন্যায় সঙ্গত দাবী বা অধিকার আদায়ের পক্ষে বিশ্বে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাহার ‘কুলিমজুর’ কবিতায় বলেছেন –
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান’!

কবির কবিতার লাইন দুটো আমাদের বলে দেয় শ্রমিকের সম্মান, প্রকৃত মর্যাদা। বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর শ্রমিকদের সম্মান জানাতে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। দিবসটি শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতির দিন। সারা বিশ্বের শ্রমজীবীদের বিজয়ের আনন্দ উৎসবের দিন। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান তুলে নতুন সংগ্রামের শপথ নেয়ার দিন।

বিশ্বের শ্রমজীবীদের ঐতিহাসিক ঐ বিপ্লব ও তাদের আত্ত্বত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যের যথাযত বাস্তবায়ন এবং এ যাবৎ কতটুকু সম্ভব হয়েছে সেটাই এই দিনের মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত। যেসব শ্রম বৈষম্য প্রতিবন্ধকতা এখনও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের পথে অন্তরায় প্রতিবন্ধক যেসব দূরীকরণের দায় রাষ্ট্র সমাজ ব্যাবস্থা ও ব্যাক্তি এড়াতে পারে না। শ্রমজীবীদের ঐ ঐতিহাসিক বিপ্ল্ব বিশ্বে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রমধিকার মানবাধিকর জীবনমান উন্নয়নের একটি স্বীকৃত দলিল। তাদের এই বিপ্ল্বের গল্প রাষ্ট্র সমাজ ব্যাক্তিকে উজ্জেবিত করার কথা।
মে দিবসের পেছনে রয়েছে শ্রমিক-শ্রেণির আত্মদান ও বিরোচিত সংগ্রামের ইতিহাস।

সেই সময় শ্রমিকদের কাজের কোনো শ্রমঘণ্টা নির্ধারিত ছিল না,ছিল না তাদের ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা। শ্রম-দাসত্বের নিগড়ে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো। একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা সপ্তাহে ৬ দিন একটানা অমানবিক পরিশ্রমের কাজ করতে হতো।
বিপরীতে মজুরী ছিল নগণ্য , এই জন্যে ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এবং তাদের এ দাবী কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১লা মে।

সমস্যা বাঁধে কারখানা মালিক পক্ষ তাদের এ দাবী মেনে নেয়নি। ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সামনে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে হাজারো শ্রমিক জড়ো হয়েছিল। ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভা যাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা এটি করেছিলেন।

আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরন ঘটে,এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশবাহিনী তৎক্ষনাৎ শ্রমিকদের উপর অতর্কিত হামলা শুরু করে যা রায়টের রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসন মূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়।

ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে। ২৬ শে জুন, ১৮৯৩ সাল ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আট জনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন, এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।

১৮৯০ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট কংগ্রেসে ১লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। মে দিবস শ্রমিকদের একটি বড় বিজয় যা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিকেরা বিজয়ের ইতিহাস রচনা করেছে।
শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবী অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর ১লা মে বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন হয়ে আসছে ।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুই প্রথম মে দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দুঃখী মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর একমাত্র স্বপ্ন। তিনি ভুলে যাননি ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবিতে আহূত প্রথম হরতালে আদমজী, টঙ্গী ও তেজগাঁওয়ের সংগঠিত শ্রমিকরাই প্রথম লাল পতাকা হাতে ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকার দিকে আসতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল। বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তির জন্য প্রথম আত্মদান করেছিল শ্রমিক মনু মিয়া সহ অন্তত পক্ষে ১০ জন শ্রমিক। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষই ছিলেন চালিকাশক্তি। এ কারণেই ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার ডাক দেননি, মুক্তির আহ্বানও জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই বাংলাদেশের শ্রমিক-শ্রেণি অসহযোগ আন্দোলনে দেশের সকল কল-কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার ডাকেই হাজার হাজার শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার ১ মে সরকারি ছুটি ঘোষণা করবেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাহার সরকার দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা ও তাহার সরকার শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদার বিষয়ে আন্তরিক তাহা ইতিমধ্যে প্রমান করিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের নিন্মতম বেতনের হার বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে মালিক পক্ষকে তা মানতে বাধ্য করেন। শিশু শ্রম বন্ধ, নারী শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় বৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, কৃষি শ্রমিক তথা ভূমিহীনদের বিনা জামানতে কৃষি ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা, মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, শ্রমজীবী ও গরিব-দুঃখী মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করতে সোস্যাল সেফটি নেট জোরদার করা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি অব্যাহত রাখা,গরিব মানুষের ঘরে ঘরে বিনামূল্যে সোলার বিদ্যুৎ ল্যাম্প সরবরাহ, কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সরকারি হাসপাতাল গুলোয় বিনা খরচে চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা ,বিনামূল্যে বই সরবরাহ করে গরিব শ্রমজীবী পরিবারের সন্তানদের জন্য অন্তত প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করে দিয়েছেন।

বর্তমান সরকারের উল্লেখিত উদ্যোগ গুলো আজ সামজে প্রশংসনীয় যা শ্রমজীবী মানুষের জীবন মান উন্নয়নে সহায়ক। প্রয়োজন এর সুষম বন্টন যথাযথ বাবস্থাপনা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণ। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধিকেই উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি মনে না করে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুফল দেশবাসী বিশেষত গরিব দুঃখী মানুষ পাচ্ছে কিনা সেটিই বিবেচ্য ধরে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কোন বিকল্প নেই ।

মহান মে দিবসে দেশের সকল শ্রমজীবী মানুষকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

নজরুল ইসলাম
ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস লন্ডন
মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিষ্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম
আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন।
trade.zoon@yahoo.

Advertisement