:ডক্টর আনিছুর রহমান আনিছ:
শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫- ১৯৭৫) একজন প্রতিযশষা বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি।
১০ই এপ্রিল ১৯৭১ – ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল আনুস্টানিক ভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম কে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্তিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি), তাজ উদ্দিন আহমেদ কে প্রধানমন্ত্রী , ক্যাপ্টেন এম মন্সুর আলীকে অর্থ , শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী , এ এইচ, এম কামরুজ্জামান কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী করে মোট ১২ টি মন্ত্রনালয় বা বিভাগ গঠন করা হয় ।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন কূটনৈতিক প্রতিভার অধিকারী সমসাময়িক কালের এক বিরল রাজনীতিবিদ ,যার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা মুজিবনগর সরকার নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের স্বাধীন ভুখন্ড উপহার দেয়।
৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধিনতা অর্জনের এই বিরল দৃষ্টান্ত বাঙালি জাতিসত্বাকে বিশ্ববাসীর সামনে গর্বিত পূনরূত্থানের সুযোগ করে দেয়।
বঙ্গবন্ধুর বিস্বস্থ সহচর এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততার এক অত্যুজ্জ্বল ধ্রুবতারা
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯২৫ সালে ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা) যশোদল বীরদামপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম পৈত্রিক নিবাস কিশুরগঞ্জের যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন৷ এরপর কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুল এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে কাটান তার স্কুল জীবন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে দুইটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন৷ ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. (অনার্স), ১৯৪৭ সালে এম.এ এবং ১৯৫৩ সালে এল.এল.বি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ৷ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৪৬-৪৭ সালে সলিমুলাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন৷ তিনি ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ৷১৯৪৭ সালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন ৷ তিনি মুসলিম হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন ৷ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি সর্বদলীয় একশন কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হবার পরও সরকারি চাকুরী প্রত্যাখ্যান করেন৷ তিনি ১৯৪৯ সালে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে আনন্দমোহন কলেজে যোগদান করেন৷ পরে ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন৷
আজীবন সংগ্রামী এবং রাজনীতিতে আত্মবিশ্বাসী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এ পদে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ৷ ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন ৷ ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হলে আইয়ুব সরকার আওয়ামীলীগের সংগ্রামী সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথমে ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এবং পরে ১০-১৩ মার্চ দু’দফা এ বৈঠক হয়৷ সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা হিসেবে এ সময় বৈঠকে যোগদান করেন।
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সংসদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাথে সারা দেশ ব্যাপী নির্বাচনী প্রচারনায় ব্যাপক ভাবে অংশগ্রহন করে দলীয় প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করেন ৷ ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ- রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুজিব নগরে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে অন্যান্যদের সাথে শপথ নেন এবং কুচকাওয়াজে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে অভিবাদন গ্রহন করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী সরকারের তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন৷
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ব ক্ষমতাবলে আইনের ধারাবাহিকতা বলবত্করণ আদেশ ১৯৭১ নামে একটি আদেশ জারি করেন। ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা রক্ষা ছিল এই আদেশের উদ্দেশ্য।
“আইনের ধারাবাহিকতা বলবত্করণ আদেশ ১৯৭১,
মুজিবনগর, বাংলাদেশ, ১০ এপ্রিল ১৯৭১, শনিবার ১২ চৈত্র ১৩৭৭; নিম্নরূপঃ
‘আমি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে এ আদেশ জারি করছি যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে। এই রাষ্ট্র গঠন বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছায় হয়েছে। এক্ষণে, সকল সরকারি, সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, তারা এতদিন পর্যন্ত নিয়োগবিধির আওতায় যে শর্তে কাজে বহাল ছিলেন, সেই একই শর্তে তারা চাকুরিতে বহাল থাকবেন। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত সকল জেলা জজ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সকল কূটনৈতিক প্রতিনিধি যারা অন্যত্র অবস্থান করছেন, তারা সকল সরকারি কর্মচারীকে স্ব স্ব এলাকায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।”
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ৷১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ময়মনসিংহ-২৮ আসন থেকে আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ৷ নির্বাচনের পর পরবর্তী মন্ত্রীসভায় ও তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ৷ জাতীয় সংসদে তিনি উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৷ পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নতুন সরকার কাঠামোতে তিনি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২য় বারের মত দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তাঁর সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের টানা দুই বার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সরকারের জন প্রশাসন মন্ত্রির দ্বায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের মতই বিরল রাজনৈতিক প্রতিভার অধিকারী তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
তাঁর আরেক সন্তান ডক্টর সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, যুক্তরাজ্যের গ্লস্টারশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের সাবেক অধ্যাপক, যিনি শিক্ষায়, প্রতিভায় পিতার মতই সততার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। আরেক সন্তান সদ্য সেনাবাহিনি থেকে অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ শাফায়াতুল ইসলাম, যিনি নিপুণ সামরিক প্রজ্ঞার অধিকারী বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসঙ্ঘ মিশনে কাজ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কনিষ্ঠ সন্তান সৈয়দ শরিফ ইসলাম, যিনি সারাজীবন পিতার মতই সাধারন জীবন যাপনে অব্যস্থ, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সাথে জড়িত। দুই মেয়ের একজন যুক্তরাস্ট্রে এবং আরেকজন যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রথমে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং পরে ২৩শে আগস্ট, ১৯৭৫ তাঁকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করা হয় ৷ কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করে কুলাঙ্গার খুনি চক্র।
আজ ৩রা নভেম্বর, বিনম্র শ্রদ্ধা ক্ষণজন্মা বিরল প্রতিভার অধিকারী এই রাজনীতিবিদের প্রতি, যিনি জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে সারা জীবনের সফল এবং রাজনৈতিক সততার প্রমাণ করে গেছেন, যা থেকে আগামী প্রজন্ম শিক্ষা গ্রহন করে তাঁর রাজনৈতিক সততার পথ অনুসরণ করে দেশকে সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি ।
লেখকঃ ডক্টর আনিছুর রহমান আনিছ, আইন গবেষক, রেডিও উপস্থাপক, মানবাধিকার কর্মী , সদস্যঃ লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব, প্রচার সম্পাদকঃ লন্ডন মহানগর আওয়ামীলীগ, সাধারন সম্পাদকঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন যুক্তরাজ্য, রাজনৈতিক কর্মীঃ কিশোরগঞ্জ- ৩ (করিমগঞ্জ- তাড়াইল) নির্বাচনী এলাকা E: anisphd@yahoo.com