শাফি নেওয়াজ শিপু ব্লগ……

“শেখার কোনো বয়স নেই”

ইংল্যান্ডের গ্রেট ইয়ারমাউথ নামক একটি জায়গায় যখন ছিলাম তখন খুব আগ্রহ নিয়ে সাইকেল চালানো শিখলাম আশেপাশের অবস্থা দেখে।

কারন ঐ জায়গায় সব বয়সের মানুষরা সাইকেল চালায়। দেখে মনে হয় সাইকেলের নগরীতে এসেছি।

এজন্য ঐ সময়ে আর ভয় কাজ করে নি।

অবশেষে  সাইকেল চালানো শিখে ফেললাম, হোক না সেটা যেকোন বয়সে। ঐ জায়গাটি পরিবর্তন করে যখন লন্ডনে আসলাম তখন আর সাইকেলটি বহন করে আনতে পারি নি।

বেশ কিছুদিন ধরে সাইকেলটিকে অনেক বেশী মিস করছিলাম, এরপর ফেসবুকে আমার ও সাইকেলের একটি ছবি সবার সাথে শেয়ার করি।

কিন্তু আমার একজন পরিচিত মানুষ ছবিটি দেখে ম্যাসেন্জারে আমাকে বলল, “বুড়ি বয়সে ভীমরতি! আরো কতো কি দেখবো!!”  আরে ভাই বুড়ি বয়সে সাইকেল চালালেও দোষ, বাল্যকালেও  দোষ তাহলে আমরা কোন সময়ে চালাবো। তারচেয়ে বড় কথা হলো এই বয়সে এসে সাইকেল চালানো শিখেছি, এটাই তো অনেক বড় ব্যাপার। তাই না!! বাল্যকালে শিখতে পারি নি কারন আমার বাবা যে সাইকেলটি কিনেছিলেন আমার জন্য, সেটি আমার উচ্চতা থেকে অনেক বড় ছিলো এবং সেই সাথে খানিকটা ভয়ও কাজ করছিলো সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ার।

এই সমস্ত কারনে একটা সময়ে সাইকেল শেখার যে আগ্রহটা তা নষ্ট হয়ে গেলো। পরে যখন আগ্রহ হলো তখন এলাকার মানুষ কি ভাববে, এই চিন্তা করে আর শেখা হলো না। তবে এখন বুঝলাম শেখার কোনো বয়স নেই, সেটা শৈশবে হোক আর বৃদ্ধ বয়সেই হোক।

আমার বাবা সবসময় আমাদের সব চাহিদাই পূর্ন করেছেন, কোনো কিছু চাওয়ার আগে সবকিছু পেয়ে যেতাম কিন্তু একটা সময়ে মনে হলো এইভাবে আর কতোদিন বাবার হোটেলে খাবো?? কিছু একটা অবশ্যই করা দরকার। অনেক কষ্টে একটা টিউশনি জোগাড় করেছিলাম, বাসা থেকে খুব একটা বেশী দুরে ছিলো না। তারপরও শান্তি নিজে কিছু একটা করবো। এরপর কোনো কিছু চিন্তা না করে শুরু করে দিলাম টিউশনি টা। বেশ কয়েকদিন হেটেঁ হেটেঁ গিয়েছিলাম টিউশনি করতে কিন্তু আর না পেরে অবশেষে রিক্সায় আসা যাওয়া শুরু করে দিলাম। তখনই সাইকেলকে অনেক বেশী পরিমানে মিস করেছিলাম, জানেন? কেন?? কারন ছাত্রীর বাসায় রিক্সায় যেতে আর আসতে ৪০ টাকা খরচ হতো, তাছাড়া খুব যে বেশী টিউশন ফিস পেতাম তাও নয়। যার কারনে মাস শেষে খুব একটা বেশী টাকা হাতে থাকতো না। তখন মনে হয়েছিলো যদি সাইকেল চালানো শিখতে পারতাম হয়তো এই ৪০টাকাটা জমাতে পারতাম। শুধুমাত্র ভয় আর মানুষ কি বলবে এইভেবে আর শেখা হলো না। ঐ সময়ে আমি যদি সাইকেল চালাতে পারতাম তাহলে হয়তো আরো টিউশনি করতে পারতাম। যাক এইভাবে দুই বছর টিউশনি করে কাটিয়ে দিলাম। যখন স্কুল জবে ঢুকলাম তখন আবদার করলাম স্কুটি চালানো শিখবো, তখন আবার অন্য কথার সম্মুখীন হতে হলো এলাকার লোকজন কি বলবে। এরপর বাবাকে বললাম, বাসে ঝুলে যেতে আর সিএনজির এতো ভাড়া দিতে আর ভালো লাগে না, নিজের একটা যানবাহন হলে অন্তত অনেক টাকা জমানো যেতো। যাই হোক বুঝিয়ে খুব একটা বেশী লাভ হয় নি। আসল কথা আমরা সবাই ভয় করি মানুষের কথাকে। কেন যে মেয়ে হলাম!! মেয়ে হওয়াতে হয়তো সব কিছু থেকে আমরা বঞিত এবং সেই সাথে সমাজে অবহেলার পাত্রী।

এইদেশে কোনো বাধা নেই বলে যেকোনো বয়সে যেকোনো যানবাহন চালানো যায়। পরিবেশ ও আগ্রহ অনেক বড় একটা ব্যাপার। হয়তো এই দুটি কারনেই আমার সাইকেল চালানো শেখা হলো। কিন্তু আমি এখনো বলবো এই প্রজন্মকে ভয়কে কাটিয়ে আর কে কি মনে করলো সেই চিন্তা করে নিজেকে কোনো কিছু শেখা থেকে বঞিত করো না। ছেলে মেয়ে বলে কোনো কথা নেই। সবাই সমান। আসলে আমাদের সমাজ ও সমাজের মানুষদের চিন্তাধারা এখনো অনেক নোংরা, সভ্য হতে পারে নি কিন্তু কথায় কথায় আমরা ভাব মারি আমরা সভ্য জাতি। জানি না কবে এই নোংরা চিন্তাভাবনা ও মনমানসিকতার পরিবর্তন হবে?? তারপরও সেই পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকলাম…..!!

লেখক:সাবেক গণমাধ্যম কর্মী,কন্ট্রিবিউটর ব্রিট বাংলা 

ACB

Advertisement