শিল্প ও সাহিত্য হাছন রাজার দিলারাম

মোহাম্মদ আনছারু জ্জামান: হাছন রাজা দেশ ও কালকে তার কবিতা ও গানে কিভাবে উপলদ্ধি করেছেন, না সব সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে বিশুদ্ধ ভাব জগতের সাথে সংযোগ স্থানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি পরম চৈতন্যের অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন।

তিনি কি নিজের বোধের মধ্যে পরাধীন ভারতের খুদে সামন্ত রাজার দ্রোহী মননের নিজস্ব প্রাণালী ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। হাউর খেরা প্রকৃতির অতৈ জলে ছেয়া নৌকায় বা কখনো ঘোড়ায় চড়ে কিশোর রাজা কৃত্রিম মহড়ার ইতি দিয়ে যুবক হাছন রাজা বর্হিলোকের দেওয়ান হাছন রাজা থেকে অর্ন্তলোকের প্রিয় দর্শনীর স্বরূপ কেমন দিয়েছিলেন।

হুনছ নি গো সই
হাছন রাজা দিলারামের মাথার কাঁকই না
এসো মইলা তোমার লাগিয়া হাছন রাজা বাউল
ভাবতে ভাবতে হাছন রাজা হইলো এমন আউলা।

হাছন রাজাকে নিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করেন প্রভাত কুমার শর্মা ১৯২৪ সালে, সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে। ১৯২৫ সালে প্রভাত কুমার শম শরমার্, হাছন রাজার ৭৫টি গান, হাছন উদাস ডাকযোগে কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রেরণ করেন। একই সালের ১শে ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান পিলোসপিকাল কংগ্রেস প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সভাপতির অভিভাষনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ব বঙ্গের (বাউল) কবি হাছন রাজার গানের অংশ বিশেষ উদৃত উদ্ধিত করে হাছন দর্শন চিন্তার পরিচয় করিয়ে দেন সুধী মহলে।

মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, হাছন দর্শনে একটি বড় তত্ত্ব পাই । সেটি এই যে ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্মন্ধ সূত্রেই বিম্ব সত্য। এই সাধক কবি দেখিয়েছেন যে, শাশ্বত পুরু ষ তাহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাহার নয়নপথে অবির্ভুত হইল, যেভাবে বৈদক ঋষি দেখিয়া ছিলেন, যে পুরু ষ তাঁহার মদ্ধে মধ্যে তিনিই অধিত্য মন্ডলে অধিষ্ঠিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপরোক্ত ভাষনটি ১৯২৬ সালের মডার্ণ রিভিউ পত্রিকায় দি পিলাসপি অফ আওয়ার পিপল নামে প্রকাশিত হয়। তিনি আরো মনে করতেন বাউল কবিরা আমাদের বাঙালীর সেই শ্রেণী হইতে আসিয়াছে যারা প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত নয় , তারা তত্ত্বচর্চা করলে তত্ত্ববিদ্যার কোন ধার ধারে না। এভাবে তত্ত্বচিন্তা ক্রমাগত মিলিবে। প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত উপাদানকে দর্শনের সঙ্গে লোকাচার, সুফি ভাবনার সঙ্গে সব ধর্মের মানুষের যুক্ত সাধনা একই সূত্রে গড়া। প্রাচীন যুগের ঋষি যেমন, মধ্যযুগের সুফি ও তেমন এ কালের বাউল এমন, প্রত্যেকেই গীত রসিক। তাদের গান ও বাণী ভাবের আগুনে দীপ্তীমান। তাদের ধর্মবোধ ও তত্বজ্ঞানের মর্মস্থল হইতে উৎসারিত।

মানব মনের চিরন্তন প্রশ্নগুলি ও জীবনের চরম স্বার্থকতা লইয়া চিন্তার আকর। কিন্তু যখন দেখি, তাদের সমস্ত বাণী, সঙ্গীত, কেবল মাত্র শিক্ষি া ত জনের জন্য নয়। তা গানে গানে নিরক্ষর নর-নারীর আধরের ধন, তখন বুঝতে পারি দর্শন বস্তুটি কী গভীরভাবে আমাদের সাধারণের মগ্ন চৈতন্যলোকে প্রবেশ করিয়াছে এবং সমস্ত জীবনে ওতপ্রোতভাবে পরিব্যপ্ত করিয়াছে।

কি ঘর বানাইমু আমি শুন্যের ও মাঝার।
ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকমু আর।

হাছন রাজাকে নিয়ে জাতীয় অধ্যাপক মুহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা, অধ্যাপক আছাদ্দর আলী, বিখ্যাত গবেষক অমিয় শংকর (কলকাতা), অধ্যাপক মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীসহ হাল আমলে অনেক কাজ হচ্ছে । শেষত সকলের মূল্যায়ন একই জায়গায়, মরমী সাহিত্য হউক বা লোক সাহিত্য হউক, হাছন রাজার সৃষ্টির উল্লাস মানব প্রেম আর খোদা প্রেমকে এককারে করে দেখেছেন, দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ মনে করতেন সুফি দর্শনে অনুপ্রাণীত সত্যিকারের মরমী কবি। তিনি বলেন –

আপন চিনিলে দেখ খোদা চিনা যায়
হাছন রাজা আপন চিনে এই গান গায়
আঁখি মুজিয়া দেখ রূপরে
আরে দিলের চেেক্ষ চাহিয়া দেখ
বন্দুয়ায় স্বরূপ রে।
অমিয় শংকর এক প্রবন্ধে নজরু ল পূর্ব যুগের যে ১২ জন মুসলমান কবি শ্যামা সংগীত রচনা করেন তাদের মধ্যে হাছন রাজাও একজন। হাছন রাজার সমসাময়িক বৃহত্তর সিলেটের লোক সাহিত্যে রাধা কৃষ্ণর প্রেম কাহিনী নিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীন ধারায় বহু কীর্তন রচিত হয়েছে। কিন্তু হাছন রাজার শ্যামা সংগীতে মরমী সাধন লোকের সন্ধান পেয়েছিলেন। জাত ধর্ম আর ভেদ বুদ্ধির উপরে উঠে সকল ধর্মের সকল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য আত্ত্বউপলব্ধতর ভিতর দিয়ে আপন করে নেন, তাই তো সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে¦ উঠে গাইলেন-
মরিয়া মরিয়া যদি শ্যামের নাগাল পাই
রাঙা চরণ ধরি জনম গোওয়াই।
ছাড়াইলে না ছাড়িমু ধরিমু চরণ
যাহা করে জগন্নাথ জগত মোহন।
অন্যত্র আরো গাইলেন
হিন্দুরা বলে তোমার রাধা আমি বলি খোদা
রাধা বলিয়া ডাকিলে মুল্লা মুন্সি দেয় বাধা।

সিলেট তথা বাঙলা ভাষা ভাষী মানুষের মনে হাছন রাজার গান ও দর্শর পরিচয় করিয়ে দিতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে সিলেট আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্র। সিলেট বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে সমস্ত শিল্পি কাজ করেছেন তাদের আমরা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে বসেছি। তাদের মধ্যে উল্লখেযোগ্য হলেন, উজির মিয়া, মোহাম্মদ ইলিয়াম, বিদিত লাল দাস, ইয়ারু ন্নেছা, সফিকুন্নুর ও আব্দুর হামিদ প্রমুখ। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত শিল্পি ছিলেন আরতী ধর, জামাল উদ্দিন, হাসান বান্না প্রমুখ ।

নিকট অতীতে প্রয়াত হুমায়ুন আহমদ হিমু চরিত্রের মাধ্যমে খণ্ডিতভাবে হলেও হাছন রাজার মানবাত্মার সহিত পরমাত্মার যে রূপটি বিভিন্নভাবে তুলে এনেছিলেন। এ ধারায় হাছন রাজার গানের ভূবনে খ্যাতি, শ্রোতাপ্রিয়তা ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। নতুন প্রজন্মের শিল্পি এখন সেলিম চৌধুরী –
লোকে বলে বলে যে, ঘর বাড়ী ভালা নায় আমার ………………………………

এ কবিতাটি ১৯৮০ দশক পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত ছিল, তা ছাড়া অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও অধ্যাপক আব্দুল হাই সম্পাদিত সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে ’, সাহিত্যের ইতিহাসে বাউল কবি হিসাবে হাসন রাজাকে পড়ানো হতো। বর্তমানে আদৌ কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তার দর্শন ও গান অন্তর্ভূক্ত আচে কি না জানা নেই।

বর্তমানে লন্ডনে হাসন রাজা ট্রাস্ট ইউকে নতুন ভাবে গবেষণা শুরু করেছে এবং হাছন রাজা ফল্ক একাডেমী সুনামগঞ্জে নতুনভাবে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ফলে নতুন প্রজন্ম হাছন রাজার তত্ব ও দর্শন জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইদানিং লন্ডনের জনপ্রিয় দুটি টেলিভিশন চ্যানেল, অন্তরে বাউল ও বসন্ত বাতাসে অনুষ্ঠান শুরু করেছে। নতুন ও পুরাতন শিল্পিদের সমন্বয়ে বৃহত্তর সিলেটের অন্যান্য মরমী সাধকদের সাথে আর বেশী করে হাছন রাজার গান নিয়ে কাজ হচ্ছে।

হাছন রাজা, সামান্ত রাজার জীবনাচার থেকে অনেক দুরে, সামান্ত জীবনের অবসরের মধ্যে সমাজ ও প্রকৃতির মত বিষয়গত নিয়েমে জেভাবে বিকশিত হয়, তেমনী হাছন রাজার কাব্যে ও মননে এ ধরণের শ্রেণী সংগ্রাম তার বেদনায় ধরা পড়ে। হাছন রাজা কেবল উদাসীন নিবৃতচারী বাউল নয়, তার প্রিয়ার রূপটি অন্তরে বার বার ধরা পড়ে।

১। হাছন জানের রূপটা দেখি ফালদি ফালদি উঠে;
চিরা বাড়া হাছন রাজার বুকের মাঝে টুটে।

২। হাছন রাজা পিরতে করিয়া বন্দুয়ারে পাইয়া,
এই কথা হাছন রাজা ফিরে গাইয়া গাইয়া।

৩। ধর দিলারাম ধর দিলারাম অব দিলারাম ধর,
হাছন রাজাকে বান্দিয়া রাখ দিলারাম তোর

কে ঐ দিলারাম সাধন সঙ্গিনী, না অন্যকেউ, না প্রতি মুহুর্তের সংশয় ও সুতীব্র মানষিক যন্ত্রনার আর্তনাথ, না আপন অস্তিত্বের অনুভব প্রতিকী ছিল দিল + আরাম = দিলারাম।

ধর দিলারাম ধর দিলারাম ধর দিলারাম ধর হাছন রাজাকে আঞ্জা করি ধর।

(উৎসর্গঃ যার অনুপ্রেরনায় এই লিখাটি শরু করেছিলাম, ভালোলাগাটা ছিল সমানে সমান আজ প্রয়াত – এস খালেক )

মোহাম্মদ আনসারুজ্জামান ১৯৮২ ইং সিলেট মুরারীচাদ কলেজ থেকে রাজনীতি বিজ্ঞান ও দর্শন শাস্রে স্নাতক। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকায় অনিয়মিতভাবে বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেন।

Advertisement