অতি উৎসাহ ও চাটুকারিতা বনাম শিল্প

অরণ্যে রোদন

অতি উৎসাহ ও চাটুকারিতা বনাম শিল্প
আনিসুল হক
২৮ জুলাই ২০১৭,

বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ
শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখলে সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাহেবের হৃদয়ে কী ধরনের কম্পন উঠবে, ভাবছি। আওয়ামী লীগের বরিশাল জেলার ধর্মবিষয়ক সম্পাদকের (আপাতত বরখাস্ত) হৃৎকম্পন দেখা দিয়েছিল একটা শিশুর আঁকা পুরস্কারপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে। শিশুর আঁকা ছবিটা একটা আমন্ত্রণপত্রে প্রকাশের দায়ে তিনি মামলা করে দেন আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে।

সৈয়দ সাহেব জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতিও। তাঁর মামলাকে গুরুতর বিবেচনা করাই স্বাভাবিক। কাজেই আইনকানুন ভেঙে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁকে হাজতে রাখা হয় ইত্যাদি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচই পড়ে। প্রশাসনেও ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল ত্বরিত ও ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রী নিজে শিশুর আঁকা এই ছবিতে আপত্তিকর কিছু দেখেননি। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম জানান, এটা অতি উৎসাহী ও চাটুকারের কাজ। আওয়ামী লীগ সৈয়দ সাহেবকে সাময়িক বরখাস্ত করে। সরকারের অনুমতি ছাড়া কীভাবে মামলা হলো ইত্যাদি আইনগত প্রশ্ন ওঠে। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধে আরও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে সোহরাব হাসান লিখেছেন, ‘প্রকৃত ঘটনা হলো, আগৈলঝাড়া উপজেলায় ইউএনও থাকাকালে তাঁর কিছু সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতা। ওই সময় তিনি স্থানীয় এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ছেলেকে ডিগ্রি পরীক্ষার সময় বহিষ্কার করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়াসহ কিছু ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছিল স্থানীয় একটি পক্ষ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোজাম্মেল হক খানের মতে, ওই কর্মকর্তার সঙ্গে আইনের আবরণে অন্যায় কাজ হয়েছে। পুলিশের আচরণও বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে।

‘মামলাটি নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু এই মামলার আসামি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা না হয়ে যদি একজন সাধারণ নাগরিক বা অন্য পেশার মানুষ হতেন, তাহলে কি ফল একই হতো? আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি এত ত্বরিত বাদীর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিত? নিকট অতীতের ঘটনাগুলো তা প্রমাণ করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মানহানি মামলার বাদীরা বাহবা পেয়ে থাকেন।’

সোহরাব হাসানের উত্থাপিত প্রশ্নগুলো খুবই স্বাভাবিক। এইচ টি ইমাম যাঁকে বলেছেন অতি উৎসাহী বা চাটুকার, তাঁরা তাঁদের অতি উৎসাহ বা চাটুকারিতা প্রয়োগ করে সুফল পেয়ে আসছেন বলেই দ্বিগুণ, তিন গুণ, দশ গুণ অতি উৎসাহ বা চাটুকারিতা প্রদর্শন করে থাকেন।

তারিক সালমন—এখন দেখতে পাচ্ছি একজন সুসংস্কৃত সাহিত্যমোদী শিল্পরসিক মানুষ। তিনি কবিতা লেখেন, বই নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর একটা কবিতা পাঠের সুযোগ হলো, নির্ভুল ছন্দে লেখা চমৎকার কবিতা। এই রকম একটা শিল্পানুরাগী মানুষকে কিনা এতটা বিড়ম্বনার শিকার হতে হলো!

অন্যদিকে আছে সৈয়দ সাহেবদের হৃৎকম্পন। ভাবছি, শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রে যদি কাঁপন উঠে থাকে, তাহলে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের আঁকা বঙ্গবন্ধু সিরিজের ছবিগুলো দেখলে তাঁর সমস্ত অস্তিত্বই না কেঁপে ওঠে। এখানে আমরা ২০১০ সালে শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও তাঁর বঙ্গবন্ধুর ছবির ফটো তুলে ধরছি উদাহরণ হিসেবে।

সৈয়দ সাহেবরা নিশ্চয়ই শাহাবুদ্দিন আহমেদকে তেত্রিশবার জেলে পাঠাতে চাইবেন। শাহাবুদ্দিন আহমেদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি দেশে ও বিদেশে অত্যন্ত সম্মানিত একজন শিল্পী, এ কথা বলেও নিশ্চয়ই তাঁদের নিবৃত্ত করা যাবে না। কিন্তু তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে জিব কাটবেন যখন জানবেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যাই শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের শিল্পকর্মের অনুরাগী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংগ্রহে এই শিল্পীর আঁকা বঙ্গবন্ধুর অনেক প্রতিকৃতি রয়েছে।

আসলে চিত্রকর্ম বোঝার সামর্থ্য, রুচি, শিক্ষা, অধ্যবসায় ও অভিজ্ঞতা সবার থাকে না। কেউ যদি কারও হুবহু প্রতিকৃতি চায়, তাহলে ফটোগ্রাফিই সবচেয়ে ভালো এবং সেটা পাড়ার স্টুডিওর পাসপোর্ট সাইজ ফটোতেই সবচেয়ে নিখুঁতভাবে আসবে। তাঁর এমনকি আমাদের নাসির আলী মামুনের তোলা পোর্ট্রেটও পছন্দ হবে না, বলবেন, মুখে এত ছায়া কেন।

শিল্পীর আঁচড়ে আঁকা প্রতিকৃতি মূল্যবান, কারণ তাতে হাতের ছোঁয়া থাকে, মনের মাধুরী থাকে, আর শিল্পী কেবল ব্যক্তির বাইরের রূপটিকে নয়, তার ব্যক্তিত্বকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে থাকেন। ভালো পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারও তা-ই করার চেষ্টা করেন।

ক্ষমতার রাজনীতি ও শিল্পের মধ্যে সম্পর্কটা অনেক ফুলবনের সঙ্গে মত্ত হস্তীর সম্পর্কের মতো হয়ে থাকে।

ক্ষমতাবানের প্রতিকৃতি এঁকে একবার বিপুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন পাবলো পিকাসো।

(এই প্রসঙ্গে বুশ কৌতুকটা আগে বলে নিই। আইনস্টাইন, পিকাসো আর বুশ গেছেন স্বর্গের দুয়ারে। প্রহরী তাঁদের আটকাল। আইনস্টাইন বললেন, ‘আমি আইনস্টাইন, ভেতরে ঢুকতে দিন।’ প্রহরী বলল, ‘আপনি যে আইনস্টাইন, কোনো প্রমাণ আছে?’ আইনস্টাইন লিখে দিলেন, ‘ই ইকুয়াল টু এমসি স্কয়ার।’ প্রহরী বলল, ‘আপনি আইনস্টাইন, বুঝতে পেরেছি। প্লিজ ভেতরে আসুন।’ এরপর পাবলো পিকাসো। পিকাসো একটা শান্তির কপোত এঁকে দিয়ে স্বাক্ষর করলেন। প্রহরী বলল, ‘বুঝেছি, আপনি পিকাসো, ভেতরে আসুন।’ বুশ বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট বুশ, আমি পরিচয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারব না।’ প্রহরী বলল, ‘এর আগে আইনস্টাইন আর পিকাসোও নিজেদের পরিচয় প্রমাণ করেই ভেতরে গেছেন।’ বুশ বললেন, ‘আইনস্টাইন? পিকাসো? এরা আবার কারা?’ প্রহরী বলল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, আপনিই প্রেসিডেন্ট বুশ। প্লিজ, ভেতরে আসুন।’)

সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্তালিন ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ মারা যান। ফরাসি কবি ও কমিউনিস্ট লুই আরাগঁ কমিউনিস্ট পার্টির আরেক সদস্য শিল্পী পাবলো পিকাসোকে অনুরোধ করেন স্তালিনের একটা ছবি এঁকে দিতে। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা লেস লেটারস ১৯৫৩ সালের ১২ মার্চ প্রথম পাতায় পাবলো পিকাসোর আঁকা প্রতিকৃতিটা প্রকাশ করে। এই ছবি দেখে ফরাসি দেশের কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সদস্য ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। কমিউনিস্ট পার্টির আরেকটা ফরাসি পত্রিকায় তীব্র আক্রমণ শুরু হয়। ক্ষুব্ধ কমিউনিস্টরা পত্রিকায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া পাঠাতে থাকেন। পত্রিকার পরের সংখ্যায় এই সব প্রতিক্রিয়ার অনেকগুলোই প্রকাশিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি তাদের কমরেডদের এই প্রতিক্রিয়াকে সাধুবাদ জানায়। কবি লুই আরাগঁ এই বিতর্কের ঝড়ে এমনকি আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলেন।

পিকাসো তখন বলেছিলেন, ‘পোর্ট্রেট আঁকার জন্য কি শিল্পীকে গজ ফিতা স্কেল নিয়ে নামতে হবে? সেটা হবে সবচেয়ে খারাপ। আমি যদি সত্যিকারের স্তালিন আঁকি, তাহলে তার মুখের দাগ, বলিরেখা, চোখের নিচে ঝুলে পড়া চামড়া আঁকতে হতো, সেটা কি ভালো হতো?’

তখন পিকাসো এক শিল্পীসুলভ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘দেখবে, একসময় আমার আঁকা স্তালিনকে অতিরিক্ত নরম বলে সমালোচনা করা হবে।’ এক বছর পরেই স্তালিনের কুকীর্তির কথা জানাজানি হতে থাকে। আরও পরে জানা যায়, স্তালিন ছিলেন ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম শাসকদের একজন। এখন একজন শিল্পসমালোচক বলেছেন, ‘আমি দীর্ঘদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিলাম। পিকাসো কীভাবে ভয়ংকর স্তালিনের এই রকম একটা নরম প্রতিকৃতি আঁকতে পেরেছিলেন?’

অতি ভক্তি বা অতি চাটুকারিতা নিয়ে একটা স্তালিন-কৌতুক আছে। স্তালিনের আমলে একবার সোভিয়েত ইউনিয়নে ঠিক করা হলো, কবি পুশকিনের একটা ভাস্কর্য বানানো হবে। প্রথমে ঠিক করা হলো, ভাস্কর্যটা হবে এই রকম, পুশকিন একটা স্বরচিত কবিতার বই পাঠ করছেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টি আলোচনা করে দেখল, এটা খুবই ভাববাদী হয়ে যাবে। তারা প্রস্তাব করল, ভাস্কর্যটা এ রকম হোক, পুশকিন বসে স্তালিনের বই পড়ছেন। শিল্পী যখন এই ভাস্কর্যটা গড়তে গেলেন, তখন মনে পড়ল, এটা ঐতিহাসিকভাবে সম্ভব নয়, পুশকিনের আমলে স্তালিনের বই ছিল না। তখন আবার সংশোধন করা হলো। শেষে যে ভাস্কর্যটা গড়া হলো, তাতে দেখা গেল, স্তালিন বসে স্তালিনের বই পড়ছেন।এ হলো অতি উৎসাহের নমুনা।

অতি উৎসাহে বাংলাদেশে নানা কিছু হচ্ছে। তাতে ক্ষমতাবানেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। কেউ কেউ একটু দ্বিধা প্রকাশ করলে প্রথম আলো পত্রিকাতেই গোলাম মুরশিদ একটা প্রবন্ধ লেখেন, তিনি যুক্তি দেখান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় কাজ আর কিছু হতে পারে না।

এই কথাটা কি অতি উৎসাহীরা বোঝেন? যিনি হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে প্রথম একটা রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন, তাঁর মর্যাদা
কত ওপরে!

আইন করে, জোর করে শ্রদ্ধা আদায়ের চেষ্টার কোনোই দরকার নেই। ইতিহাস তার আপন গতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলছে। তুলবে। যতই দিন যাবে, ততই বঙ্গবন্ধু আপন মহিমায় চিরভাস্বর হয়ে উঠবেন। আবার শিল্প-সাহিত্যের জন্য দরকার হয় স্বাধীনতা। ঐতিহাসিক সত্য বলার দায় শিল্পীর নেই, তাঁর কাজ অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের সত্য আর সত্যের সৌন্দর্যকে তুলে ধরা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। জবরদস্তির দরকার নেই। লৌহযবনিকা তো নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় ও চরম ক্ষতিকর।

তবে এই দেশের অসুবিধা হলো স্তাবকতা, অতি উৎসাহ, চাটুকারিতা বৈষয়িক সুবিধা দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মানুষের এই দুর্বলতার কথা জানতেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বাঙালির পরশ্রীকাতরতার বিষয়ে লাখ কথার এক কথা বলে গেছেন। শামসুজ্জামান খানের এক স্মৃতিকথায় পড়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেছিলেন এই দেশের ঐতিহাসিক দারিদ্র্যের কথা। বলেছিলেন, মানুষের হাতে কখনো টাকা ছিল না। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের কলকাতার কাছেই বই থেকে উদাহরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, একটা পয়সার জন্য এক মেয়ে বাবার কাছে কত কাকুতি-মিনতি করছে। সেই বাঙালি স্বাধীনতা পেয়েছে, এখন গাড়ি চালায়, বিদেশি সিগারেট খায়। টাকার জন্য এরা বেপরোয়া। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

টঙ্কাই চাটুকারিতায় অতি উৎসাহ দেয়। ক্ষমতার আনুকূল্য লাভজনক বলে প্রতীয়মান হয়। সেটা সমাজের অনেক শ্রেণির মানুষ ও পেশাজীবীদের নষ্ট করছে।

আমরা মধ্য আয়ের দেশ হচ্ছি, এখন আমাদের সভ্যভব্য হতে পারতে হবে। সুশাসন ও সুনীতি প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করার এখনই সময়।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কৃতজ্ঞতা:প্রথমআলো

ACB#17

Advertisement