এবারের নির্বাচন দাবা খেলার নির্বাচন!

রফিকুল হায়দার 

আর ক’সপ্তাহ মাত্র বাকি আগামী সাধারণ নির্বাচনের, কিন্তু এখন পর্য্যন্ত কোন দলই তাদের চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রকাশ করছেনা। প্রত্যেকটি দলই প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়ে আবার সেটাকে অনেক জায়গাতেই রদবদল করছে।

যারা ইমিধ্যেই চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়ে তাদের এলাকায় নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন, এরপরই দেখা যাচ্ছে আবার রদবদল হয়ে গেছে। এই রদবদলের ক্ষমতা দলের কর্তা ব্যক্তিদের হাতে। কেউ কিছু বলার নেই, দল করতে হলে তাদের কথা মানতেই হবে। তবে কথা হচ্ছে, চূড়ান্ত এই মনোনয়ন প্রকাশে কেন এত হিমশিম খাচ্ছে দলগুলোকে। প্রত্যেকেই চায় আগে অমুক দল চূড়ান্ত করুক তারপর সেই দলের প্রার্থির সাথে টেক্কা দেয়ার মতো আমরাও প্রার্থী দেবো। এ রকম করতে ক্রতে দেখা যাবে হয়তো মাত্র দু’তিন সপ্তাহ বাকি নির্বাচনের। তখন হয়তো বিরোধী জোটগুলো প্রশ্ন তুলতে পারে, এত কম সময়ে আমরা নির্বাচন কিভাবে করবো, আমাদের প্রার্থীরাতো তাদের এলাকার জনগণের কাছে যেতেই পারেনি, সুতরাং নির্বানের তারিখ পেছানো হোক।

নির্বাচনের তারিখ পেছানোর জন্য ইতিমধ্যেই যুক্তফ্রন্ট নেতা ড: কামাল হোসেন সিইসি’র সাথে যোগাযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। তবে দলের কোন কোন এলাকার প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠি দেওয়ার পরও আবার দেখা যাচ্ছে, এদের মনোনয়ন বাতিল করে অন্য একজনকে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ দলে নিজেদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সেটাকে মেনে নিচ্ছেন এমন কি যাদের নিশ্চিত মনোয়ন দেয়া হয়েছে তাদের পক্ষে কাজ করারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করছেন আবার কেহ কেহ দল বদল করে অন্য দলে গিয়ে ভিড়ছেন! বলছেন দল আমাকে মূল্যায়ন করেনি।

এতে একদিকে যেমন প্রার্থীদের হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে এলাকার লোকজনের মধ্যেও অসন্তোষের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে একটি জিনিষ লক্ষনীয় যে, বিভিন্ন দলের নেতাদের দলবদলের যে মহড়া শুরু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই রাজনীতি করছেন দলের বা দেশের স্বার্থে নয়। এটা বাংলাদেশের জনগণের কাছে পরিস্কার হয়ে উঠেছে, এরা যে দলেরই হোন না কেন জনগণের দৃষ্টিতে তারা ক্ষমতালোভী। এজন্য আমি ধন্যবাদ জানাই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

তিনি যে একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ তার প্রমাণ তিনি এবার দিয়েছেন। এবারের নির্বাচনের কৌশলটা তিনি এমন ভাবে সাজিয়েছেন, তাতে যে যে দলেরই নেতা হোন না কেন তাদের নিজের দলের প্রতি কতটুকু আস্থা আছে বা দেশের প্রতি কতটুকু মায়া আছে তা পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।

এদের মধ্যে অনেকেই এই পরীক্ষায় ফেল করেছেন আবার কেউ কেউ পাশ করেছেন, কি চমৎকার আইডিয়া। অতীতে আমরা দেখেছি এসব দলছুট নেতারা অন্যদলে গিয়ে যোগদান করলেও তাদের সেই ইজ্জত আর সাধারণ মানুষের কাছে থাকেনা। এবারের নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, এসব দলছুট নেতাদের যারা সারা জীবন বাংলাদেশের বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলেন আজ তাদেরই দলের নেতা হয়ে তাদের প্রতীক হাতে নিয়ে স্বগর্বে তাদের পক্ষেই ভোট চাইছেন! এরাই নাকি স্বাধীনতার পক্ষের সৈনিক!
এ দিকে, ২৭ নভেম্বর সম্পাদক ডট কম অনলাইন পত্রিকার এক খবরে বলা হয়েছে, “কথা ছিল, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল একসঙ্গে প্রার্থীতা দেবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাতীয় পার্টি ও যুক্তফ্রন্ট মিলে একত্রে প্রার্থীতা দেবে।
নির্বাচনের মাঠে যেন এ সিদ্ধান্তের উপরেই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু নাটকীয় ভাবে নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলের ঠিক আগের দিন থেকেই নানা রকম মেরুকরন দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনে ফ্রন্ট আলাদা প্রর্থীতা দিচ্ছে, গতকাল সোমবার থেকে ২০০ আসনের মনোনয়ন প্রপ্তদের চিঠি দেয়া শুরু করেছে জাতীয় পার্টি।
এদিক জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পৃথক পৃথকভাবে মনোনয়ন জমা দেন তারা। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে কাকতলীয় মনে হলেও রাজনৈতিক পর্য্যবেক্ষক মনে করছেন,সব ঘটনাগুলো একই সূত্রে বাঁধা। কেননা, যেদিন এমন ঘটনা ঘঠেছে সেদিনই বিএনপি’র ৫ নেতা- আমান উল্লা আমান, ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব, মশিউর রহমান, ড: জাহিদ হোসেনের মনোনয়ন অযোগ্য করা হয়েছে।
এরচেয়েও বিএনপির জন্য বড় ধাক্কা হচ্ছে, দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেননা, এ বিষয়ে দলটি মোটামুটি নিশ্চিত। এ প্রেক্ষাপটেই রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হয়েছে বলে জানা গেছে। রাজনৈতিক পর্য্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, এটা আওয়ামী লীগের একটি রাজনৈতিক কৌশল।”
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর মতো কোনো নির্বাচন যেন না হয় সে লক্ষ্যেই ভোটের মাঠ ফাঁকা রাখতে চায়না চায়না দলটি। এজন্য পার্টি আলাদা প্রার্থীতা দেয়,ঐক্যফ্রন্টে দ্বিতীয় প্রধান দল গণফোরাম আলাদা প্রার্থীতা দেয়,সেই সঙ্গে যুক্তফ্রন্টও আলাদা প্রার্থীতা দেয়। বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ, বিএনপির অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা নির্বাচনের মাঠ থেকে ছিটকে পড়ার কারনে , পাশাপাশি দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে না পারায় এবারের নির্বাচন থেকেও সরে আসতে পারে বিএনপি। এসব কারণেই শেষ মূহুর্তে এসেও নির্বাচনের তেমন কোন প্রস্তুতিই নেয়নি দলটি। এখনো বিএনপি থেকে নির্বাচনের মনোনীত প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকাতে ফিরে যাননি। এমনকি দলের মাঠ পর্য্যায়ের কর্মীদের সংগঠিত করা, নির্বাচনী ইশতেহার তৈরী সহ নির্বাচনের সকল যাবতীয় খুঁটিনাটি প্রস্তুতিতে তেমন কোন আগ্রহই নেই যেন দলটির মনোনীত প্রার্থীদের। মনে করা হচ্ছে, বিএনপি হয়তো এমন নাজুক অবস্থার সম্মুখীন না হয়ে বরং নির্বাচন থেকে সরে দাড়াবার সিদ্ধান্তই নিতে পারে শেষ পর্য্যন্ত।”
এখন আসা যাক, ড; কামাল হোসেনের গণফোরাম নামক রাজনৈতিক দলটির কথায়। আজকাল দেখা যাচ্ছে গণফোরামে বিভিন্ন দলের দলছুট নেতারা এসে ভীড় জমাচ্ছেন। তার কারন খুঁজলে দেখা যায়, একমাত্র এই দলটিই আছে যার কাছে গিয়ে রাজনীতি করার আশ্রয় পাওয়া যাবে। আর ড: কামাল হোসেনও হয়তো ভাবছেন এ দল গঠন করায় তাঁর কৃতিত্ব বাড়ছে এমনকি ভবিষ্যতে হয়তো একটি বড় দল হিসেবে তাঁর দল গণফোরাম আত্মপ্রকাশ করবে। শেষ বয়সে এসেও এই আইন বিশেষজ্ঞ ড: কামাল হোসেন যে খেলাটি খেলছেন শেষ পর্য্যন্ত এই খেলায় তিনি কতদিন টিকে থাকতে পারবেন তার কি নিশ্চয়তা আছে? তিনি যে তাঁর মহাপ্রভু জনাব তারেক রহমানের ফাঁদে পা দিয়েছেন, তিনি কি একবার ভেবে দেখেছেন তার পরিণাম কি হবে? যদি তিনি বিএনপির ধানের শিষ না নিয়ে বরং নিজের দলের একটা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতেন তাহলে হয়তো ভবিষ্যত উজ্বল ছিলো। গণফোরামে নেতারা বলছেন, তাদের দলের দীর্ঘ ২৫ বছরের রাজনীতিতে এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের দলে অনেকে ভীড় করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধূরী বলেছেন, এখন দল বদলের পেছনে নির্বাচনে আসন পাওয়া ছাড়া আদর্শ বা অন্য কোন বিষয় নেই। অনেকে আবার সরাসরি বিএনপিতে যেতে লজ্জাবোধ করছেন। এতোদিন বিএনপির সবকিছু খারাপ বলে এখন হঠাৎ করে বিএনপিতে যোগদিলে জনগণের কাছেওতো মুখ দেখানো যাবেনা। মানুষ সমালোচনা করবে। কাজেই গণফোরামে কাঁদে পা রেখেই ঘাট পাড়ি দেবো।
গণফোরামের কার্য্যনির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরীও মনে করেন, আসনের জন্যই তাদের দলে এখন অনেকেই যোগ দিতে পারেন।
রাজনৈতিক অবস্থাদৃষ্টে অনেকেই আশংকা প্রকাশ করছেন যে, এই নির্বাচন বানচালের জন্য একটি দল ভেতরে ভেতরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পেছনে রয়েছে একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠন যারা কোন সময়েই বাংলাদেশের অগ্রগতি চায়না। সুতরাং এ ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে কঠোর নজর রাখতে হবে, দেশের স্বার্থে, দেশের সার্বভৈৗমত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এদের প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
তবে সব শেষে বলতে হচ্ছে, এবারের নির্বাচন হচ্ছে দাবা খেলার মতো। যারা দাবা খেলেন তাদের জানা আছে, দাবা খেলতে গিয়ে দাবার গুটিকে যদি চালাকি করেই হোক আর ভুলবশত:ই হোক ভুল চাল দিয়ে দেন তাহলে কিন্তু হার নিশ্চিত, তা আর শোধরাবার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনেও যারা প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করবেন সেই ভুলের খেসারত তাদের দিতেই হবে। আমি বলবো এবারের নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক চমকপ্রদ নির্বাচন, যা আগে কোনদিনই হয়নি। আগে নির্বাচন আসলে বোঝা যেতো কোন দল নির্বাচনে জেতবে, এবার কিন্তু তা নয়। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান! আমার বিশ্বাস এই দাবার চাল চালতে আওয়ামী লীগের মেধাবী নেতাদের ভুল হবেনা।

রফিকুল হায়দার (কলামিস্ট,রাজনৈতিক বিশ্লেষক)

Advertisement