সিলেটে আর আহুমনারে

।। মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম রাজু ।।

দিন যায় মাস যায় বছর যায়,ঘুরে ফিরে চৈত্র-বৈশাখও আসে যায়, তবে বৈশাখ মাসটা এলেই বারবার ফেলে আসা জীবনে ফিরে যেতে মন চায়।আগেকার দিনে অন্যান্য জেলার লোকজন দলবদ্ধ ভাবে আমাদের ভাটি বাংলায় আসতেন, ধান কাঁটা শ্রমিক হিসেবে।কেউ বলতেন দাউয়াল আর আমাদের ভাষায়, বেপারি। আর তাদের ভাষায় বেপারি হচ্ছেন দলপতি বা সরদার, বাকিদের বলা হয় ভাগি।আমাদের এলাকায় বেশি দেখা যেত মানিকগঞ্জ জেলার লোকজনকে। এক সময় নাকি মাঘ ফাল্গুন মাসে বেপারিরা এসে মহাজন বা গৃহস্ত ধরে জমির রেখে যেতেন এর পর সময় মতো দল নিয়ে আসতেন।আমাদের মৌসুমটা শুরু হবার পর অনেক সময় মহাজনকে বেপারির বাড়িতে গিয়ে জমি দিয়ে আসতে হত।এর পর দেখা যায় ছোট বড় দল আর কাঁটের তৈরি পাঁচ ছয়শো মন ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন নৌকা কখনো লগি দার বৈঠা বেয়ে আবার কখনো গুন টানতে টানতে গন্তব্যে পৌঁছলো।

কুশিয়ারার নদীর পাড় ঘেষা পুরাতন কাদিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালের পূর্বদিকে বাঁশ হাটার ওখানে নৌকা থাকতো।বিবিয়ানা নদীর যৌবনকালে নাকি আমাদের কাকমারা এলাকায়ও এসব নৌকা থাকতো, দু একবার অবশ্য আমরাও দেখেছি আমাদের এদিকে আসতে, যদিও বিবিয়ানা নদীর সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে।যাকগে, পাঁকা তেঁতুল পিঁয়াজ মিষ্টি আলু শুকনো মরিচ হলুদ ইত্যাদি আসতো তাদের নৌকায় করে। নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি ধানের বিনিময়ে বেচাবিকিও চলতো।এরা খুবি কর্মট, সেই সাত সকালে গিয়ে যে লাগলো বিরামহীন চলছে সন্ধ্যা পর্যন্ত, মনের আনন্দে গাইতো নানা রঙের ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া গান।আমাদের এখানে জুকের যন্ত্রনাটা তখনো ছিল। তাদের বলতে শুনা যেত, কালা পোকায় ধরে, সিলেটে আর আহুমনারে।তাদের একেকটি কাচি দা’য়ের মতো লম্বা, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছোট ছোট দাঁত রয়েছে, দেখতেও চমৎকার, আমাদের এখানকার একটি কাঁচি যখন পাঁচ ছয় টাকা, তাদেরটা তখনি পচিশ টাকা।আর বাঁশও সম্ভবত তালের পাতা দিয়ে বানানো খুবি শক্ত একটি ছাতা মাথায় থাকতো, তাদের ভাষায়, মাথাইল।অনেকগুলি ধানের আটি দিয়ে উঁচু করে বোঝা বেঁধে দুই তিনজন মিলে দিলো মাথায় তুলে।এসব বোঝা দেখলে ভয় লাগতো, ভাবতাম কিভাবে যে বহন করে, কিন্তু যার প্রয়োজন তাকে যে করতেই হবে।

নৌকায় থাকা বাবুর্চি সাহেব রান্না করে রাখলেন, আর বেপারি সাহেব বাঁশ দিয়ে খুবি শক্ত করে বানানো টুকরিতে করে খাবার নিয়ে আসতেন, অনেক সময় সকালের নাস্তা সিদ্ধ করা মিষ্টি বা লম্বা আলু, দুপুরে ভাত, এরা ভালো রান্না করতে জানে, খাবার নিয়ে পাশদিয়ে হেটে গেলেও সুগ্রাণ মিলতো।তখনকার দিনে হাওড়ের ডুবা বিল কিংবা জমির পানি আজকের চেয়ে সুস্থ্য ছিল, খাওয়া যেত। সকল সময় বাড়ি থেকে নিতে হত না। তাদের চলাফেরা খাওয়া দাওয়া পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।তখন ধান কাটা ছিল ভাগ হিসেবে, যেমন আট নয় কিংবা দশভাগ করে একভাগ বেপারির বাকিগুলি গৃহস্তের।বেপারিরা মাড়ায় মাড়ায় খালি বস্তা দিয়ে রাখতেন,দিনশেষে ভাগিরা মাথায় করে নায়ে ফিরতেন। কোনো রকম রাতটা কাঁটিয়ে আবার কুশিয়ারা পাড় থেকে পাও পাও করে ছড়িয়ে পড়লো নলুয়া হাওড়ে। আর ভাগের এসব ধান নাড়াচাড়া আর শুকানোর কাজটাও বাবুর্চির।বৈশাখের পিঠাপুড়া রোদ বৃষ্টি আর অন্যদিকে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড় ভাঙা খাটুনি, তাতেও যেন ক্লান্তি হয়রানি নাই।কাজ কামাই করতে করতে নৌকাখানা ভরে গেল, বৈশাখও শেষ হয়ে এলো, এবার বাড়ি ফেরার পালা। আনন্দটাই আলাদা,চলছে নৌকা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আর সাজ সজ্জার কাজ।কাগজও কাপড় দ্বারা তৈরি করা মালা, ধানের ছড়ার মালা নৌকার গায়ে শোভা পেত। গৃহস্তেরা সামর্থানুযায়ি গরু ছাগল রাজহাঁস উপহার দিলেন, তারাও হাঁসিমুখে বরন করতেন। বিদায় বেলা কত রঙের ডাক আর আনন্দ উল্লাসের মধ্যদিয়ে যে নায়ের বাঁধ খোঁলা হত সেটা না দেখলে বিশ্বাস করার কথা না।এভাবে আসা যাওয়ার মধ্যদিয়ে কেঁটেছে অনেকগুলি বছর আর যুগ, সময় বদলেছে, এখন আর তারা আসেনা, নৌকাও দেখা যায়না গানও শুনা যায়না।

লেখক : সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী।

Advertisement