শীর্ষ ১০ ট্রেন্ড ২০১৮

তৌহিদা শিরোপা :: এই তো কদিন আগের কথা। ধানমন্ডি ৭ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে এক অনুষ্ঠানের মহড়া চলছিল সকাল থেকে। লাঞ্চ ব্রেকের পর আবার মহড়া চলবে। মহড়ার চার-পাঁচজন ছেলেমেয়ে ঠিক করল, ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কের স্টার হোটেলে খেতে যাবে। যাবেটা কিসে করে? প্রত্যেকের ফোনেই উবার অ্যাপ রয়েছে। দু-একজনের আবার ডিসকাউন্টও আছে। তো উবার ডেকে গাড়িতে করেই তারা খেতে গেল। ঘটনাচক্রে শুনলাম এটা। ‘এত কাছে, উবারে যেতে হলো?’ তাদের একজন জানাল, ‘আমাদের ডিসকাউন্ট ছিল। যেতে লাগল ২৮ টাকা, ফিরতে ৩৫ টাকা। রিকশায় গেলেও এর থেকে বেশি খরচ হতো!’এই হলো অবস্থা। যাতায়াতের জন্য উবার, পাঠাও, টিকিট কেনার জন্য সহজ—এসবই ২০১৮ সালের শহুরে জীবনযাপনে প্রভাব ফেলেছে প্রবলভাবেই। ক্যালেন্ডার পাল্টানোর সময় যখন ঘনিয়ে আসে, রাষ্ট্র-সমাজ, প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিজীবনেও অনেকটা অজান্তে হলেও একটা হিসাব-নিকাশ করা হয়ে যায়। কেমন কাটল বছরটা? এ বছরে নতুন নতুন কী কী এল?

ঘরোয়া অনুষ্ঠান ঘরের মধ্যে, রেস্তোরাঁ বা কমিউনিটি সেন্টারে করার চেয়ে এবার দেখা গেল খোলা জায়গায় এসব অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের লন বা বাগান থাকলে তো কথাই নেই। না থাকলে ছাদ তো অবারিত খোলা। জন্মদিনের পার্টিতে ম্যাজিক, উপহারসহ নানা আয়োজন থাকে। খোলা জায়গায় হলে এমন আয়োজন জমে যায়। আবার পারিবারিক অনুষ্ঠানে নানা বয়সের অতিথি থাকায়, তারা আলাদা করে আড্ডাও জমাতে পারে। আর দু–তিন বছর ধরে স্বাস্থ্যসচেতনতার মধ্যে ওজন কমানো, ব্যায়াম করা, জিমে ভর্তি হওয়া জীবনযাপনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে।

এবার একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক ২০১৮ সালে জীবনযাপনে কোন ধারাগুলো জোরালোভাবে প্রভাব ফেলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রবণতা, পর্যবেক্ষক, লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞদের মত, অধুনা ফেসবুকে পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া মন্তব্য এবং অধুনা লেখকদের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করে এই শীর্ষ তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত বছর থেকে গুরুত্ব দিয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি। যিনি তাঁর মনের যত্ন নেন, তিনি সত্যিকার অর্থে আধুনিক। শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মন, সম্পর্ক, সন্তানপালন বিভিন্ন বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কাউন্সেলরের কাছে পরামর্শ নেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামালও তেমনটাই বলেন। মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন, যোগব্যায়ামের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে শহুরে মানুষদের।

জীবনযাপনের ধারায় আঠারোয় যেসব যোগ হলো, অনেকখানি মিশে গেল নিত্যদিনের অভ্যাসে—উনিশেও সেগুলোর রেশ থাকবে, তা সহজেই অনুমেয়। কোনো ধারা হবে আরও বেগবান, গভীরভাবে হয়তো মিশে যাবে আমাদের জীবনধারায়।নারীর হয়রানির বিরুদ্ধে আন্দোলন
গত বছর শুরু হওয়া হ্যাশটাগ (#) মি টু আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এরপর আন্দোলনটা সারা বিশ্বের মেয়েদের নিরাপত্তার আন্দোলন হিসেবে দাঁড়াল। ভারত, বাংলাদেশেও এই আন্দোলন দানা বেঁধেছে। বলিউডের বড় বড় অভিনেতা, ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের সম্পাদকও বাদ যাননি। বাংলাদেশেও খ্যাতিমান ও সাধারণ নারীদের ফেসবুকে হ্যাশট্যাগ মি টু দিয়ে নিজেদের হয়রানির কথা প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

হলিউড নায়িকা অ্যাশলে জুড পেশাগত কারণে দেখা করতে গিয়ে ১৯৯৭ সালে চলচ্চিত্রশিল্পের ক্ষমতাধর ব্যক্তি মিরাম্যাক্স স্টুডিওর কর্ণধার হার্ভি ওয়াইনস্টিনের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হন। ২০১৭ সালে তিনি এ ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন। গত বছরের অক্টোবরে একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন হলিউডের ডজনখানেক পেশাজীবী নারী, অভিনেত্রী। শুরুটা হয় ৫ অক্টোবর প্রকাশিত দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ও ১০ অক্টোবর প্রকাশিত দ্য নিউইয়র্কার–এর দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে। এরপর ১৫ অক্টোবর ২০১৭। অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো হলিউডে পেশাজীবী নারীদের যৌন নিগ্রহের ব্যাপারে জেনে ক্ষুব্ধ-অপমানিত স্বরে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে লিখলেন, ‘আপনিও যদি এমন যৌন নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন কখনো, তবে এই টুইটের উত্তরে স্রেফ লিখুন মি টু—আমিও!’ পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে মিলানো দেখেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর টুইটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দুই লাখ নারী লিখেছেন এই কথা—‘আমিও’! সংখ্যাটা বাড়তে থাকল। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল।

অনলাইন বিনোদন
বাংলাদেশে এ বছর চালুর পরপরই জনপ্রিয় হয় ভিডিও স্ট্রিমিং সেবা নেটফ্লিক্স। এখানকার সিরিজ, সিনেমার সমালোচনা নিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আছে গ্রুপ। শুধু নেটফ্লিক্স নয়, দেশি সেবা আইফ্লিক্স, বায়োস্কোপ মিডিয়া শুধু ওয়েবের জন্য নাটক তৈরি করছে।অ্যাপনির্ভর–যাতায়াত সেবা নগরজীবনে বেশ দেখা গেছে এ বছর। মডেল: মৌসুমি, ছবি: সুমন ইউসুফরাইড শেয়ারিং
চোখ বন্ধ করে একবার যদি ভাবতে বলা হয়, ২০১৮ সালের নাগরিক জীবনে বা আমাদের জীবনযাপনে বড় পরিবর্তন কোথায় এসেছে। যাতায়াতকে সহজ ও সাশ্রয়ী করার জন্য উবার, পাঠাও, সহজ, ওভাই, কিছুটা হলেও ওবোনের কথা আসবে। ঢাকায় উবার ও পাঠাওতে চলাচল করে না, এমন লোকের সংখ্যা নেহাত কম। ২০১৬-এর ২২ নভেম্বর ঢাকায় চালু হয় উবার। দুই বছর পর গত নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রামে উবার ও উবার মটোতে নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা এক লাখ। ভাবা যায়! পাঠাওয়ের নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার (জুন ২০১৮ পর্যন্ত)। ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঠাও সেবা চালু আছে। সহজ ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা মালিহা এম কাদির জানালেন, এ বছর সহজ রাইড চালু হওয়ার পর ৬০ হাজার বাইক ও গাড়িচালক এতে যুক্ত হয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় ১৫ লাখ যাতায়াত হয় সহজ রাইডে। আগামী মাসে চট্টগ্রামে এ সেবা চালু হবে। রাইড শেয়ারিং সেবায় অনেক তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগও হয়েছে।সিয়াম ও তাঁর স্ত্রী অবন্তীকত কায়দার বিয়ের আয়োজন
রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান জানালেন, এখন বিয়েতে বেশ কিছু অনুষ্ঠান হয়। পানচিনি, গায়েহলুদ ছাড়াও মেহেদি, আইবুড়ি ভাত ইত্যাদি অনুষ্ঠান যোগ হয়েছে।

এত দিন গায়েহলুদে নাচগান করতে দেখা যেত, এ বছর দেখা গেল বিয়ের বর–কনে বিয়ের দিন সিনেমার ঢঙে বন্ধুদের নিয়ে নাচতে নাচতে চলে আসেন। সম্প্রতি অভিনেতা সিয়ামকে দেখা গেল আক্‌দের অনুষ্ঠানে স্ত্রী অবন্তীর সঙ্গে নাচতে।

ষাটের দশকের বিয়েবাড়ির সাজের মতো করে অনেককে সাজাতে দেখা যায়। নতুন কিছু লোকজ সামগ্রী যোগ করে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

চল এসেছে কিটো ডায়েটের
ওজন নিয়ে চিন্তা ও নানা রকম ডায়েট করার একধরনের সচেতনতা দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। স্বাস্থ্যসচেতনেরা সারা বছর এই অধ্যবসায়ের মধ্যে থাকেন। একেক সময় আবার ডায়েটের নতুন নতুন তরিকাও চোখে পড়ে। ২০১৮ সালে পাশ্চাত্যে, এমনকি আমাদের দেশেও কিটোজেনিক ডায়েট বা কিটো ডায়েট করার প্রবণতা দেখা গেছে। এ বিষয়ে ফেসবুকে কয়েকটি গ্রুপ খোলাও হয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা ও যাঁরা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে ওজন কমিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন সেখানে।

পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো জানালেন, কিটোজেনিক ডায়েট হলো মূলত সুপার লো-কার্ব ডায়েট। এই ডায়েটে শর্করা কম থাকবে, আমিষ মধ্যম মানের ও চর্বি সবচেয়ে বেশি থাকবে, অর্থাৎ কিটোজেনিক ডায়েটে শর্করা ৫ শতাংশ, প্রোটিন ২৫ শতাংশ আর চর্বি ৭০ শতাংশ থাকে। আমিষ বেশি থাকায় এই ডায়েট করলে সহজে খিদে পায় না। ফলে অন্যান্য ডায়েটের থেকে এটার ওজন কমানোর হার ২ দশমিক ২ গুণ বেশি। এই ডায়েট রক্তের শর্করা বা ইনসুলিন মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে দীর্ঘদিন এই ডায়েট করা যাবে না। কারণ, শরীরে পানি ও খনিজের ঘাটতি দেখা দেয়। এটা কমাতে ১ দশমিক ৫ থেকে ২ চামচ লবণ সারা দিনে খাবারের সঙ্গে খেতে হয়। ওজন নিয়ন্ত্রণে জিম, ইয়োগা করার প্রতিও সমান আগ্রহ দেখা গেছে।দোরগোড়ায় খাবার
রেস্তোরাঁয় গিয়ে নানা রকম খাওয়ার চল আগেও ছিল, এখনো আছে। অনেক রেস্তোরাঁ মিলে নানা স্বাদের নানা দেশের খাবার নিয়ে যেমন শেফস টেবিলের মতো ফুড কোর্ট চালু হয়েছে। আবার পাঠাও, ফুড পান্ডা, হ্যাংরি নাকি, এমনকি রেস্তোরাঁগুলো নিজেরাও খাবার ফোনে বা অনলাইনে অর্ডার নিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছে দিয়ে আসছে।ঢাকার গুলশানে ও’প্লে নামের একটি জায়গায় মেয়ে আলাইনার জন্মদিনে সাকিব পরিবার। ছবিটি ফেসবুক থেকে নেওয়াখোলা জায়গায় পারিবারিক অনুষ্ঠান
বিয়ে–গায়েহলুদের জন্য কয়েক বছর ধরে খোলা জায়গা বেছে নিতে দেখা গেছে। সামর্থ্য-সুযোগ থাকলে রিসোর্ট ভাড়া নিয়ে করেছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি সাকিব আল হাসান তাঁর মেয়ে আলাইনার জন্মদিনও এমন একটি খোলা জায়গায় করেছেন। সবাই মিলে যাতে নিজেদের মতো গল্প করতে পারেন, শুধু গেলেন আর খেয়ে চলে এলেন—এমন যাতে না হয়, সে কারণে এ ধরনের জায়গার প্রতি ঝোঁক।

বড় বা বাচ্চা—যে অনুষ্ঠানেই হোক না কেন, শিশুদের খেলার ব্যবস্থা করে রাখা হচ্ছে।বেঙ্গল বই। ছবি: সংগৃহীতবই পড়া আর কফি পান
বই নিয়ে হইচই করা তরুণদের কাছে একটা ‘কুল’ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বইয়ের দোকান যেমন বইয়ের পাশাপাশি কফির ব্যবস্থা রেখেছে, তেমনি কফির দোকানগুলোতেও বই রাখা হচ্ছে। ২০১৭ থেকে শুরু হলেও আঠারোয় এসে এ ধারা বেশি গতি পেয়েছে। বেঙ্গল বই, বাতিঘর ঢাকা, দীপনপুর, পাঠক সমাবেশ বড় বইবিপণি চালু করায় বই নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বেড়েছে বৈ কমেনি। বেঙ্গল বইয়ের ম্যানেজার অপরাশেনস গোলাম সারোয়ার জানালেন, শীতকালে প্রতিদিনই বেশ জমজমাট থাকে বেঙ্গল বই। গত বছরের তুলনায় বিভিন্ন বিভাগে বিক্রি, বইপ্রেমীদের আসা–যাওয়ার হার বেড়েছে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ।

বইমেলা ছড়িয়েছে সারা দেশে। প্রথমা প্রকাশন বিভিন্ন স্থানে বইমেলা করেছে। সরকারি উদ্যোগেও কিছু মেলা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিতে এবার অংশ নিয়েছে মোট ২০ লাখ ৮২ হাজার ছাত্রছাত্রী। এটা ইতিবাচক দিক। নার্ডি বিনস, নর্থ অ্যান্ড কফি রোস্টারস ধানমন্ডি, চর্চার মতো ক্যাফেতে রয়েছে কফির পাশাপাশি বই পড়ার ব্যবস্থা।ইউটিউব থেকে জনপ্রিয়তা
অপরাধী গানের ভিউ এখন পর্যন্ত ১৯ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই গান ইউটিউবে প্রকাশ করেন আরমান আলী। তিনি বুঝতে পারেননি, এই গান তাঁকে এ বছরের তারকা বানিয়ে দেবে। তাঁর গান কভার করে (গেয়ে) টুম্পা হয়ে যান আরেক ইউটিউব তারকা। আর মাহতিম সাকিব পুরোনো দিনের বাংলা গানকে নতুন করে গেয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছেন।

Advertisement