চুল তার কবেকার…

অনার্য তাপস :: চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা… কিংবা কুচবরন কন্যা তার মেঘবরন চুল—নারীর চুলের বর্ণনা নানাভাবেই দিয়েছেন আমাদের কবি–সাহিত্যিকেরা। আর কেশচর্চার ইতিহাস তো অতি প্রাচীন। যুগ যুগ ধরে চলছে কেশচর্চার নানা প্রয়াস। সুন্দর চুল সৌন্দর্যের একটা নিয়ামক, তেমনি কাব্যেও অনিবার্য কেশের বর্ণনা।

শ্রাবণ মাসেতে যেন কালো মেঘ সাজে।

দাগল-দিঘল কেশ বায়েতে বিরাজে।।

কখন খোঁপা বান্ধে কন্যা কখন বান্ধে বেনি।

কূপে রঙ্গে সাজে কন্যা মদনমোহিনী।।

(কমলা-দ্বিজ ঈশান)

চুলের সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক থাকলেও চুলের প্রসঙ্গে জেগে ওঠে ‘কুচবরন কন্যার মেঘবরন চুল’ চিত্রকল্প। এই চিত্রকল্প আজকের নয়, ঐতিহাসিক কালের। সে জন্য চুলের কথা উঠলেই মনে পড়ে ‘ঢালুয়া খোঁপা’ আর দিঘল কালো চুলের নারীদের কথা। মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’ মনে পড়ে মহুয়া, মলুয়া, কমলা, বেহুলার মতো কিংবদন্তির নায়িকাদের, যাঁরা দিঘল কালো চুলের অধিকারী ছিলেন।

মনে পড়ে লম্বা সোনালি চুলের রূপাঞ্জেলের কথা। পাহাড়ের অনেক উঁচুতে রাক্ষসী যাকে আটকে রেখেছিল। পরে এক রাজপুত্তুর রাপাঞ্জেলের নামিয়ে দেওয়া সুদীর্ঘ সোনালি চুল বেয়ে সেই উঁচু ঘরে উঠে এসে রাক্ষসীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল তাকে।

মনে পড়ে বেণির কথা, কাঁটার কথা; মনে পড়ে হাতির দাঁতের চিরুনির কথা, বাঁধানো আয়নার কথা। আর মনে পড়ে নারকেল তেলের কথা। গ্রীষ্মের ধূসর দুপুরে বাইরের দাওয়ায় বসে দাদি তাঁর ছটফটে নাতনির দিঘল কালো চুলে নারকেল তেল ঘষে দিচ্ছে গল্প শোনাতে শোনাতে, কেশ পরিচর্যার এই স্মৃতি বাঙালি ভুলতে পারবে কোনো দিন? কিংবা তেল চুপচুপে চুলে রঙিন ফিতায় বাঁধা বেণি দোলাতে দোলাতে বাবার আঙুল ধরে ছোট্ট মেয়েটির মেলায় যাবার স্মৃতিও কি ভুলতে পারবে বাঙালি? চুল মানেই স্মৃতি, চুল মানেই ভালোবাসার এক অমোঘ বটিকা!

কেশচর্চা বাঙালি নারীর নিজস্ব জীবনচর্যার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্য, জড়িয়ে আছে রুচি আর আভিজাত্যের গরিমা। কেশচর্চাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নারীদের অন্তঃপুরের এক নিজস্ব জগৎ, যা বাইরের দুনিয়া থেকে আলাদা। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে দুপুরের কাজ শেষে যে বিরতি মেলে কিংবা ঘনঘোর বর্ষায় যখন বাইরে বের হওয়ার কোনো উপায় থাকে না, তখন আর দশটা কাজ শেষ করে নারীরা বসাত কেশচর্চার আসর।

গ্রামীণ পরিসরে এখনো এ রকম আড্ডা বসে নারীদের। শাশুড়ি, ননদ, জা, পাড়ার অন্য নারী, গৃহকর্মী মিলে অন্দরমহলে জমে ওঠা নারীদের এই নিজস্ব আড্ডা থেকে রন্ধনকৌশলের মতো কেশচর্চার কৌশলও ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্মান্তরের মানুষদের কাছে। কারণ নারীরা জানে, তার দিঘল কালো চুল তাকেই আগলে রাখতে হবে। রেশমি, ঝরঝরে, উজ্জ্বল চুল সবাই ভালোবাসলেও নারীর শণের মতো দলাপাকানো চুল কেউ পছন্দ করে না। তাই সে নিজের গরজেই শিখে নেয় কোন মাটিতে চুল কেমন পরিষ্কার হয়, কোন গাছের পাতা বা ফুল বেটে চুলে লাগালে চুলের উজ্জ্বলতা বাড়ে, নারকেল তেলের সঙ্গে আর কী মেশালে চুল হবে ঘন কালো, কত ধরনের খোঁপা হতে পারে আর কে কত রকমের খোঁপা বাঁধতে পারে, কোন চুলে কেমন বিনুনি করলে চুল লম্বা হবে এসব বিদ্যা। বাঙালি নারীরা এই বিদ্যার চর্চা করে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

কেশচর্চা বলতে চুল বিষয়ে সামগ্রিক ধারণাকে বোঝায়। এর মধ্যে আছে চুল লম্বা করা, চুল পড়া রোধ করা, চুলকে কালো আর উজ্জ্বল করা, চুলকে সতেজ রাখা, চুল পাকা রোধ করা, চুলের বিনুনি করা, খোঁপা বাঁধা ইত্যাদি। এ ছাড়া আধুনিককালে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চুলকে রঙিন করা এবং পছন্দসই চুল কাটা।

কেশচর্চার জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হোমরেমিডি। এসব টোটকাও নারীরা শিখে নেয় পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে। এই হোমরেমিডিতে কী নেই? মেহেদিপাতা, ডিম, এলোভেরা, নিমপাতা, লেবুর রস, মধু, অলিভ অয়েল, কলা, ক্যাস্টার অয়েল, টক দই, আমলকী, জবা ফুল, বিভিন্ন মসলা, বিভিন্ন ফল, সবজি, রসুন-পেঁয়াজ ইত্যাদি। এগুলোর আবার একেকটির একেক রকম কাজ। কোনটি চুল কালো ও উজ্জ্বল করে, কোনটি চুল করে মসৃণ, কোনটি আবার চুল গজাতে সহায়তা করে তো কোনটি চুল পড়া রোধ করে। এগুলো সবই মোটামুটি বিশ্বাসের ওপর চলে। যেমন লবঙ্গ এবং লেবু বিষয়ে বিশ্বাস হচ্ছে, এগুলো মাথার ত্বকের সংক্রমণ দূর করে চুল গজাতে সহায়তা করে। মেথি খুশকি দূর করে, জবাফুল চুলকে ঝলমলে মসৃণ করে চুলর বৃদ্ধি ঘটায়। আবার পেঁয়াজ চুল কালো করে চুলকে ক্যারোটিনসমৃদ্ধ করে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে থাকে। এগুলোর বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা আছে কী নেই, সেটা বলা বাহুল্য। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাক বা না থাক, এই হোমরেমিডি ব্যবহারে ব্যবহারকারী একধরনের মানসিক তৃপ্তি পায় সঙ্গে কিছু না কিছু উপকার পায় বলে এই ধারা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই পুরো ব্যাপারটি চলে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ঘরানার সূত্র ধরে।নানা ধাঁচে চুল সাজানোর রীতি শুধু এই সময়েরই নয়, বরং প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছেএই একবিংশ শতকে চুলের যত্নে ভেষজ জিনিসপত্রের ব্যবহার যেমন হয়ে থাকে, তেমনি হয়ে থাকে রাসায়নিক দ্রব্যে তৈরি পণ্যেরও। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, হেয়ার কালার, হেয়ার কাট অন্যতম। তবে চুলের যত্নে রাসায়নিক দ্রব্যের চেয়ে মানুষ সম্ভবত ভেষজ দ্রব্যের প্রতি বেশি আস্থাশীল। যে কারণে দেখা যায়, বিখ্যাত কোম্পানির তেলের বোতলে কোনো উদ্ভিদের শিকড়! নারকেল তেলে যতই রাসায়নিক থাক না কেন, প্রচার করা হয় সেটি প্রাকৃতিক নারকেলের নির্যাস থেকেই তৈরি। অন্যদিকে এখনো মানুষ চুল কালো রাখতে হেয়ার কালারের চেয়ে মেহেদির ওপর বেশি নির্ভরশীল, যার প্রমাণ পাওয়া যায় কাঁচাবাজারের থলে থেকে উঁকি দেওয়া তাজা মেহেদিপাতা দেখে।

নারীর মতো পুরুষও কেশচর্চা করে। তবে পুরুষের ‘কেশচর্চা’ বিষয়টা ঠিক জমে না। নারীর কেশচর্চার যে বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল ভুবন রয়েছে, পুরুষের সে ভুবন নেই। সেটা হোক বাঙালি পুরুষ কিংবা আফ্রিকান পুরুষ অথবা ইউরোপের পুরুষ। এর বড় কারণ সম্ভবত চুলের আকার। পুরুষের চুল যেহেতু ছোট তাই এর চর্চার তেমন কোনো আড়ম্বরতা প্রয়োজন হয় না। স্নানের পর চুল আঁচড়ে নেওয়া, নাপিতের দোকানে চুল কাটানোর সময় একটু সময়োপযোগী কাট দেওয়া, জুলফির চুলটা সাদা লাগছে বা মাথার চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে বলে একটু কালো করে নেওয়া কিংবা ধোপদুরস্ত কেতার জন্য একটু জেল মেরে নেওয়া—এই হলো পুরুষের চুলচর্চা। শৌখিন পুরুষ যে নেই, সেটা বলা যাবে না। তবে স্বীকার করতে হবে, নারীদের মতো আড়ম্বরতা নেই পুরুষের চুলের যত্নের ক্ষেত্রে।

নারী হোক বা পুরুষ, মানুষের সৌন্দর্যের সঙ্গে, ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চুল। চুল শূন্য মাথার বাস্তবতা থাকলেও সে দৃশ্য আমাদের খুব একটা শান্তি দেয় বলে মনে হয় না। তাই চুল থাক আমাদের মাথায়। চুলের যে বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল চর্চার ভুবন সেটাও অক্ষুণ্ন থাক যুগ যুগ।

Advertisement