ধীরে ধীরে এ বৃক্ষপ্রেমীর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠল। তিনি বৃক্ষবিষয়ক সংগঠন তরুপল্লবের গাছ চেনানোর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে খুলনা থেকে ঢাকায় এলেন কয়েকবার। তাঁর দেওয়া মাধবীলতার চারা ২০১৭ সালের মে মাসে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে লাগিয়েছি। সেদিন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মাও উপস্থিত ছিলেন। তরুপল্লবের সঙ্গে এটাই ছিল তাঁর গাছ লাগানোর শেষ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি ছিল তাঁর জন্মদিন ঘিরে।অবশেষে গত ২০ এপ্রিল সুযোগ হলো বৃক্ষপ্রেমী তৈমুরের বাগান দেখার। ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে খুব ভোরে গিয়ে পৌঁছালাম খুলনায়। সেখান থেকে সরাসরি ডুমুরিয়ায় তাঁর বাগানবাড়িতে। তৈমুর ইসলাম স্বাগত জানালেন। বাগানের এক পাশের দেয়াল ঘেঁষে দক্ষিণ ভারতীয় আদলে দোতলা বাড়ি। সে বাড়ির একটি ঘর আমার জন্য বরাদ্দ হলো।
ঘরে বসেই দেখতে পেলাম নীল বনলতা আর সহস্রবেলী। ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে এলাম বাগানে। সে কী, এই নীল বনলতার পাতার রং যে ভিন্ন! পাশেই আছে সাদা রঙের থানবার্জিয়া, কমলা লাল রঙের টেকোমা, নীল গাছ আর ভিন্ন গড়নের লঙ্কাজবা। এমন লঙ্কাজবা আগে কখনো দেখিনি।পাশের দেয়ালে আছে শ্বেতশুভ্র ও সুগন্ধি মাদাগাস্কার জুঁই আর রক্তন। পাশে নতুন জাতের স্থলপদ্ম, মাধবী, কনকচাঁপা, গোল্ডেন ফিংগার, বকফুল ও রাজ অশোক। যেদিকে তাকাই সেদিকেই বিচিত্র সব বর্ণাঢ্য ফুলের সমারোহ। কোনটা রেখে কোনটা দেখি। খেই হারানোর অবস্থা।
বাগানের এক কোণে উঁচু ডাকুরগাছটি দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম সাদা কাঠগোলাপ। কিন্তু বৈসাদৃশ্যময় পাতা বাদ সাধল। গাছটি সুন্দরবন অঞ্চলের, ফুল সুগন্ধি। শেষ প্রান্তের সীমানা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাওবাব। তার পাশে ছোট্ট পুকুরপাড়ে দেখা পেলাম দুটি সুদর্শন কাঞ্চন ফুলের। এর মধ্যে একটি হলদে বহিনিয়া বা বনচাঁপা। জন্ম বৃহত্তর ঢাকা ও চট্টগ্রামের বনে। রং চোখ ধাঁধানো। স্বভাবে গুল্মশ্রেণির বা ঝোপালো। পুকুরপাড় ঘুরে খানিকটা এগিয়েই পেলাম সুগন্ধি কুন্দ, বিচিত্র রঙের ঢাউস আকৃতির কিছু জবা আর মধুগন্ধি স্বর্ণচাঁপা। বাগানের মাঝখানে পাওয়া যাবে নানা রঙের বেশ কিছু কাঠগোলাপ। কাঠগোলাপের এসব রকমফের সচরাচর চোখে পড়ে না। সব মিলিয়ে বাগানের সংগ্রহে রয়েছে ৩০ রকম কাঠগোলাপ।চার পাশে ছড়িয়ে থাকা ট্যাবেবুইয়াগুলোর রং বেশ চোখ ধাঁধানো। গোলাপি এবং পঞ্চপত্রী গাঢ় বেগুনি জাত তার মধ্যে অন্যতম। আছে ব্ল্যাকবিন, ঝুমকোলতা এবং বড় জাতের রাজঘণ্টাও। বাগানের ভেতর ক্রিমফ্রুট, পাখিফুল আর অ্যাডেনিয়াম রঙের পসরা সাজিয়ে বসেছে। ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা ইউটার্নের মতো করে যে গাছটির সামনে এসে দাঁড়ালাম তা জানামতে এ দেশের বিরলতম সংগ্রহগুলোর মধ্যে একটি। গাছটির পরম আত্মীয় আমাদের কাছে রুদ্র পলাশ নামে পরিচিত। একই গাছ, ফুলও একইÑ পার্থক্য শুধু রঙের। রুদ্র পলাশের রং লাল, এটি হলুদ। অপূর্ব স্নিগ্ধ শোভা।
এর আগে হলুদ রঙের পেথোডিয়া কখনো দেখিনি। গাছটির আশপাশেই একঝাঁক দুর্লভ ফুলের দেখা মিলল—ক্যাশিয়া গ্লাওকা, রুদ্র পলাশ, বাঁশপাতা, বিউমন্টিয়া, ফিডেলউড ট্রি, উদয়পদ্ম, সুদর্শন পারিজাত, হলুদ পলাশ, জহুরিচাঁপা, গড়মিঙ্গা, গোলাপি ম্যাগনোলিয়া, পানামা কুইন, লতাজবা, সাদা রঙের পাখিফুল, গোলাপি ট্রাম্পেট, সিলভার ওকের একটি নতুন জাত, আতমোড়া (ইন্ডিয়ান স্ক্রু ট্রি) ইত্যাদি।বাগানটি এক চক্কর ঘুরে দেখে আমরা ঘরের সামনেই চা পানে বসি। এমন একটি সমৃদ্ধ বাগানের স্বপ্নদ্রষ্টা তৈমুর ইসলাম পেশায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা। বর্তমানে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করছেন।
কার অনুপ্রেরণায় এই ব্যতিক্রমী কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়ালেন? তৈমুর বললেন, ‘অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। আমি সব সময় তাঁকে অনুসরণ করেছি। তাঁর লেখা আমাকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে।’ ২০০৮ সালে পারিবারিক ৫ বিঘা জায়গার ওপর এ বাগান তৈরির কাজ শুরু করেন তৈমুর। ১০ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে সেখানে ২০০ প্রজাতির প্রায় ৭০০ গাছের সংগ্রহ গড়ে তুলেছেন। আরও কিছু সংগ্রহের মধ্যে ৩৫ রকম জবা, ১২ রকম চাঁপা ও ৬ জাতের ক্যাশিয়া উল্লেখযোগ্য। বাগানটি উদ্ভিদবৈচিত্র্য আরও সমৃদ্ধ করার ইচ্ছে রয়েছে তৈমুর ইসলামের।