যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী তারকাদের জীবন

মনজুর কাদের ::দুই দশক আগেও সিনেমায় শাবানার অবস্থান ছিল বেশ উজ্জ্বল। তখনই হুট করে স্বামীর সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। গত দুই দশকে এই তালিকা আরও লম্বা হতে থাকে। এখন তো অনেক তারকাই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন। কেউ আবার আবেদন করে অপেক্ষা করছেন প্রবাসী হওয়ার। কেন তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন, কেমন আছেন এবং কীভাবে কাটছে তাঁদের জীবন—ঢাকা থেকে নানা মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, জানা গেছে তাঁদের প্রবাসজীবনের কথা।

পরিবারের টানে প্রবাসী প্রিয়া ও টনি ডায়েসসন্তানদের জন্য মন মানছিল না
স্বামী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে চিত্রনায়িকা শাবানার সাজানো সংসার। এ লেভেল শেষে বড় মেয়ে সুমী ইকবালকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। এর এক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় ছোট মেয়ে ঊর্মি। শাবানা বলেন, ‘সন্তানেরা আমাকে মিস করছিল। দেশে ওরা আমার চোখের সামনেই ছিল, কাজের ফাঁকে দেখাশোনা করতে পারতাম। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর তা সম্ভব হচ্ছিল না। মা হিসেবে কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য তো আমার আছে। তাই ছেলে নাহিনকে নিয়ে আমি আর ওয়াহিদ সাদিক যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। অভিনয় তো অনেক করলাম। এখন সন্তানদের সময় দেওয়া দরকার। সিনেমার জগৎটাও আমার একটা পরিবার ছিল। রাত-দিন বিরামহীন কাজ করেছি। মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন আর কোনো উপায় থাকে না। সন্তানদের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ওই সময় সন্তানদের কথা ভেবে যুক্তরাষ্ট্রে আসাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে।’

দুই ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখন যুক্তরাষ্ট্রে বিপ্লবজীবন তো একটাই

নাটকে অভিনয়ের দিক দিয়ে সমসাময়িকদের তুলনায় টনি ডায়েসের অবস্থান বেশ এগিয়ে ছিল। জনপ্রিয়তা থাকার পরও নাটক আর চলচ্চিত্রে অভিনয় নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। দেশে থাকা অবস্থায়ও টনি ডায়েস অভিনয়ের পাশাপাশি বায়িং হাউসের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার। তিন দশক ধরে তাঁর মা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। মামা–চাচারা আরও আগে থেকেই সেখানে। পরে টনি ডায়েসও তাঁদের টানে স্ত্রী প্রিয়া ডায়েস ও একমাত্র কন্যা অহনাকে নিয়ে পাড়ি জমান মার্কিন মুলুকে। বর্তমানে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে থাকেন তিনি।
মোনালিসা এখন বিউটি অ্যাডভাইজারযুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে টনি ডায়েস বলেন, ‘শুধু আমার দিকের আত্মীয়রা নন, প্রিয়ার দিকের সবাইও যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। আমি আমার নাটকে অভিনয় নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না। ছোটবেলা থেকে আমি দেখে আসছিলাম, আমাদের সিনিয়র শিল্পীরা শেষ বয়সে করুণার পাত্র হন। যদিও অভিনয় আমার পেশা ছিল না। গার্মেন্টস, বায়িং—এসবের পাশাপাশি অভিনয় করতাম। ২০০৩ ও ২০০৪ সালের দিকে মনে মনে ভাবতে থাকলাম, আমার দেশের নাটক, সিনেমা–গান নিয়ে দেশের বাইরে এক্সপ্লোর করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ সেভাবে ভাবেওনি। তাই এমন অনিশ্চয়তা নিয়ে পড়ে থাকার কোনো কারণ দেখছিলাম না। দুই নৌকায় পা দিয়ে তো জীবন চলে না। জীবন একটাই। তাই একে সময় থাকতে কাজে লাগাতে হবে।’

টনি ডায়েস যুক্তরাষ্ট্রে হিলসাইড হোন্ডার সেলস ম্যানেজার। বললেন, ‘শুরুতে এই প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যান ছিলাম। এখন তো বেশ ভালোই আছি।’

সিঙ্গেল মাদার
নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন ইপশিতা শবনম শ্রাবন্তী। হাসি আর অভিনয় দিয়ে সে সময় তরুণদের ‘ক্রাশ’ হয়ে উঠেছিলেন। রং নাম্বার নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। কিন্তু বিয়ের পর কাজ কমিয়ে দেন। একটা সময় দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। ভাবতে ভাবতে যুক্তরাষ্ট্রই প্রাধান্য পায়। এখন দুই সন্তান নিয়ে নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকেন শ্রাবন্তী। বললেন, ‘একটা সময় যাওয়া–আসার মধ্যে ছিলাম। পরে ভাবলাম, সন্তানদের সুন্দর ও নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আমার জন্য উত্তম জায়গা। আমি যেহেতু সিঙ্গেল মাদার, একা হাতে সন্তানদের বড় করতে হচ্ছে, তাই এখানে সুযোগ–সুবিধাগুলো আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করবে। এখানকার সরকার এসব ব্যবস্থা করে রেখেছে।’ 

ফ্লোরিডায় ইমন সাহাবিচ্ছেদের কারণে প্রবাসে
২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়েছিলেন মডেল ও অভিনেত্রী মোনালিসা। সেই সফরের একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে পছন্দ হয় নিউইয়র্কপ্রবাসী ফাইয়াজ শরীফকে। এরপর দুই পরিবারের কয়েকজন সদস্যের উপস্থিতিতে মোনালিসা ও ফাইয়াজের বিয়ে হয়। বাংলাদেশে ফিরে ঢাকাতেও জমকালো আয়োজনে বিবাহোত্তর সংবর্ধনা হয় মোনালিসা ও ফাইয়াজের। কিন্তু সেই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। বিচ্ছেদের আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করতে মোনালিসাকে অনেকটা সময় নিউইয়র্কে থাকতে হয়। একটা সময় নিউইয়র্কের প্রতি ভালো লাগা জন্মায়। সেখানে নতুন কিছু বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়ে যান তিনি। কয়েক বছর ধরে স্থায়ীভাবে তিনি সেখানেই আছেন। কাজ শুরু করেন একটি প্রসাধন ব্র্যান্ডের জ্যেষ্ঠ মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে। মোনালিসা বলেন, ‘এরপর আমি বিউটি অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করি এবং পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। এখন কাজ করছি সেফোরা ব্র্যান্ডের বিউটি অ্যাডভাইজার হিসেবে।

এখন নিউইয়র্কের কুইন্সের বাসিন্দা মোনালিসা বললেন, যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, অনেক কিছু শেখার আছে। সুযোগ–সুবিধা ও নিরাপত্তা বেশি। আমি সেই সুযোগটা নিতে এসেছি। এরপর হয়তো ভবিষ্যতে আমার জানার অভিজ্ঞতা নিজের দেশেও কাজে লাগাতে পারব

নিজের ও সন্তানদের পড়াশোনা

সংগীত পরিচালক ইমন সাহা এখন সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার বাসিন্দা। দুই ছেলেকে সেখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি নিজেও সেখানে পড়াশোনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব তাঁর অনেক আগে থেকেই ছিল। তবে পরিবার সেখানে নিয়ে যাওয়ার করার কারণ হিসেবে তিনি বললেন, ‘আমার বাচ্চারা বড় হচ্ছে, ভাবলাম ওদের পড়াশোনা এখানেই হোক। আমার নিজেরও সংগীতের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার ইচ্ছা ছিল। ফ্লোরিডার ফুল সেল ইউনিভার্সিটিতে এ কারণেই আবেদন করি এবং বৃত্তি পেয়ে যাই। মিউজিক প্রডাকশনের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছি। চলচ্চিত্রের আবহ সংগীতের ওপর স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি করার ইচ্ছা আছে। মিউজিক থেরাপির ওপরও পড়াশোনা করতে চাই।’

মেয়ের জন্য শ্রাবন্তী আছেন যুক্তরাষ্ট্রেদেশের বাইরে থাকলেও নিয়মিত বাংলাদেশে গানের কাজ করছেন ইমন সাহা। এই ঈদে মুক্তি পাওয়া পাসওয়ার্ড সিনেমার আবহ সংগীত তাঁর করা। তিনি বলেন, ‘যেহেতু সংগীত বিষয়ে পড়ছি, ইচ্ছা আছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করার। হলিউডের তিন–চারটা প্রজেক্টের ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে আলাপও হয়েছে। দেখি কত দূর এগোতে পারি। হলিউড অনেক বড় বাজার, এখানে ঢোকা অসম্ভব কিছু না, তবে কষ্টসাধ্য।’

আরও যাঁরা
এলআরবি, সোলস, মাইলস, নগর বাউল, আর্ক—জনপ্রিয় এসব গানের দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছিল প্রমিথিউস। অনেক দিন ধরে গানের দলটির কোনো খবর নেই। কারণ, দলটির প্রধান বিপ্লব এখন নিউইয়র্কপ্রবাসী। স্ত্রী, তিন সন্তানসহ সেখানেই থাকছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের আরও অনেক তারকা স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মিলা হোসেন, রোমানা, রিচি, নাফিজা জাহান, শশী প্রমুখ।

Advertisement