ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: পৃথিবীব্যাপী অনেক নারী-পুরুষ যারা একা আছেন, একাই থাকেন। অনুভূতির পাল্লা তাদের ভারী, কারও সঙ্গে ভাগ না করার কারণে। বর্তমান যুগে ভালো একজন মানুষ পাওয়া কঠিন। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পারিবারিক দৈন্য, অভিভাবকদের পছন্দ ও ব্যক্তিগত পছন্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব, আর্থসামাজিক অবস্থা- এসব কারণে অনেক মেয়েই বিয়ে থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হন। অনেকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে আজীবন ত্যাগ স্বীকার করে যান। বিবাহিত মেয়েদেরও সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া চোখে পড়ে। সে ক্ষেত্রে পরকীয়া, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন- এসবই দায়ী। কেউ কেউ আবার কাঙ্ক্ষিত মানুষকে না পেয়ে বিয়েই করেন না কোনোদিন। আবার কেউ কেউ একা থাকতে বেশি ভালোবাসেন। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি একা থাকেন এবং এ হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আমাদের দেশে মেয়েদের এই একক জীবনযাপন খুব সহজ নয়। সে যত উচ্চ পর্যায়ের হোক না কেন। ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে তার রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক ভোগান্তি।
পড়াশোনার কারণেই হোক, কর্মক্ষেত্রের কারণে কিংবা জীবনে চলার পথে কোনো জটিলতার বাঁকে একা থাকার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয় নারীকে। একা থাকা। সেখানে থাকে সুখ, থাকে জড়তাও। এই শূন্যতার সৃষ্টি কখনও ইচ্ছাকৃত, কখনও অনিচ্ছাকৃত।
নিঃসঙ্গতা, একঘেয়ে সময় কাটানো, অসুখ-বিসুখে যত্নহীন- এগুলো ব্যক্তিগত ভোগান্তি। মানুষের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে যন্ত্রণা ধেয়ে আসে, একঘেয়ে লাগে, তখন হয়তো সেভাবে একান্ত কাউকে পাওয়া যায় না। অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাওয়া থেকে শুরু করে সব খরচের ভার নিজেরই। তখন মনে হয়, কেউ থাকলে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকা যেত।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে মানুষ অসহায়, আদর-যত্নহীন হয়ে পড়ে। প্রিয়জনদের কাছ থেকে দূরে থাকার বিমূর্ত বেদনা থাকে তাদের, যা অনতিক্রম্য। মা-বাবা যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণ নিজেকে ধরে নেওয়া যায় একটি অদৃশ্য সংসার সদস্য। পরিবারে যাতায়াত, ভালো-মন্দ অনুভূতি জানানোর মাধ্যমে মন হালকা হয়। মা-বাবা পরপারে চলে গেলে পারিবারিক আর কোনো আশ্রয়, কোনো সান্ত্বনা থাকে না।
সামাজিক দিক থেকেও যেন ভোগান্তির শেষ নেই। মানুষের বাজে সন্দেহ, কটূক্তি, বিয়ে সম্পর্কিত নানা উল্টাপাল্টা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সমাজের বাঁকা চোখ উপেক্ষা করে কোনো পারিবারিক-সামাজিক অনুষ্ঠানেও যাওয়া হয়ে ওঠে না। একই কারণে পরিবারের লোকেরাও চায় না তার উপস্থিতি।
পশ্চিমা দেশগুলোয় অবিবাহিত মেয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। সেখানে মোট নারীর প্রায় অর্ধেকের মতো অবিবাহিত থাকে। ২০১০ সালে জাপানে ৩০ বছর বয়সী এক-তৃতীয়াংশ নারী অবিবাহিত থেকে গেছে এবং তাদের বিয়ে না করার সম্ভাবনাই বেশি। বিয়ের আগেই তারা লিভ টুগেদারে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সমাজ তাদের অনায়াসে সে সমর্থন দেয়। বিয়ে ছাড়াই তারা সংসার করে, সন্তান জন্ম দেয়। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, এশিয়ার মেয়েরা একা থাকে, আবার সচরাচর লিভ টুগেদারে জড়ায় না। জড়ালেও সেটা প্রত্যক্ষ নয়। কারণ সমাজ এটা ভালো চোখে দেখে না।
একা জীবনযাপনের ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। ভালো দিকগুলোর মধ্যে পড়ে বন্ধু-আড্ডা, নিজস্ব রুচিবোধ, স্বাধীনতা, সিদ্ধান্তের একক প্রাধান্য, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন। আর মন্দ দিকগুলো হলো অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদে কাছের মানুষ না পাওয়া। তাছাড়া বাইরে থেকে কাজ করে এসে সন্ধ্যায় ঘরের তালা খুলে অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করার তিক্ত অনুভূতি। সে মুহূর্তে স্বভাবতই নিজেকে অসহায় লাগে মানুষের। সংসার, সন্তান, হৈচৈ চায় অধিকাংশই। কিন্তু স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের ভয়, শেষ বয়সে সন্তানের আশ্রয় পাওয়ার অনিশ্চয়তা আবার বিয়েবিদ্বেষী করে তোলে। আমাদের সমাজের জন্য এই একা থাকার সিদ্ধান্ত ভালো ফল বয়ে আনে না। তবু সামাজিক প্রথার বাইরে টিকে থাকা যেন তাদের একরকম প্রতিবাদ। ওরাও পারে জীবনকে যাপন করতে, সে প্রমাণই দেয় তারা জীবনের প্রতিটি বাঁকে।
একা থাকাটাকে কিছুটা উপভোগ করেন রাজধানীর অনেক মেয়ে। আফরিনা আজিম কর্মক্ষেত্রের কারণে রাজধানীতে একা বাসা ভাড়া করে থাকেন। একা থাকাটাকে তিনি কিছুটা উপভোগই করেন। তার মতে, ‘একলা থাকলে উদ্যম ফিরে পাওয়া এবং নিজেকে রিচার্জ করা যায়। আমাদের প্রত্যেকেরই এমনকি সবচেয়ে বহির্মুখী স্বভাবের লোকটিকেও উদ্যম ফিরে পেতে এবং নিজেকে রিচার্জ করে নিতে হয়। একাকী সময় কাটানোর মাধ্যমেই একমাত্র এটা সম্ভব। একাকী থাকার সময় আপনি যে শান্তি, নীরবতা এবং মানসিক নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন তা আপনাকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ধকল থেকে মুক্ত করতে সহায়ক হয়।’
যারা একা থাকেন, তাদের বিষয়ে পরামর্শ কিছুটা এমন- নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। স্বাধীনতা আপনাকে নিজের ওপর আস্থা বাড়ানোর সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করবে। আপনি কে, আপনি কী জানেন এবং আপনার জন্য কী ঠিক আর কী বেঠিক- সেসব বুঝতে পারবেন। একা থাকা আত্মসম্মানবোধ বাড়ায়। একাকী নিজের সঙ্গ উপভোগ করলে উচ্চহারে আত্মসম্মানবোধ বাড়ে। একাকী সময় উপভোগ করা শেখার মাধ্যমে আপনার আত্মসম্মানবোধ বাড়বে; কারণ এর মধ্য দিয়ে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন যে, নিজেকে উপভোগ করার জন্য অন্যদের সঙ্গ দরকার নেই আপনার। আপনি নিজেই সর্বেসর্বা।
আবার একা থাকতে গেলে আপনি অন্যদের আরও বেশি মূল্যায়ন করতে শিখবেন। একাকী থাকার সময়টুকুতে আপনি লোককে সম্পূর্ণ নতুন আলোয় দেখার সুযোগ পাবেন এবং আরও পরিস্কার করে তাদের বুঝতে পারবেন। এতে লোকের প্রতি আপনার শ্রদ্ধাবোধও বাড়বে। বেশি মানসিক পরিশ্রম করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, দলবদ্ধভাবে মানসিক পরিশ্রমের উৎপাদনশীলতা অনেক কম। কারণ এতে চিন্তা করার একটা সীমা টেনে দেওয়া হয়। ফলে নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা বা সৃজনশীলতার ব্যবহার করে নতুন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। যত বেশি লোক দলবদ্ধ হয়ে কাজ করবে, ততই তাদের ব্যক্তিগত উৎপাদনশীলতা কমে আসবে। একাকী সময় কাটানোর সুযোগ পেলে কোনো বিষয়ে যেমন গভীরভাবে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়, তেমনি অন্যদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনাও রহিত হয়।
সমাজে বাঁকা চোখের অভাব নেই। বাঁকা কথা বলার লোকেরও অভাব নেই। নিজেকে ভালো রাখার জন্য সবকিছু উপেক্ষা করে নারী যখন একা থাকবে দৃঢ় মনোবলে, সম্মানের সঙ্গে, তখনই সার্থক হবে আমাদের সমাজব্যবস্থা।