২৮ নভেম্বর বুধবার। চঞ্চল চৌধুরী আয়নাবাজি সিনেমার একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন। তার নিচে পড়তে থাকে ভক্তদের মন্তব্য। এক ভক্ত লেখেন, ‘একবার যদি আপনারে সামনে পাইতাম…’। প্রিয় তারকাকে একটু ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা সব ভক্তের মনে থাকে—এই স্বাভাবিক। সেই তারকার সঙ্গে আড্ডা দিতে কাওরান বাজার থেকে রওনা হই, গন্তব্য—স্বপ্নীল শুটিং হাউস, উত্তরা।
কোনো ভিড়ভাট্টা নেই বাড়ির সামনে। ভেতরে ঢুকলেই যখন লাইট–ক্যামেরার দেখা মেলে, শোনা যায় সংলাপের শব্দ, তখন বুঝতে পারি, ঠিক জায়গায় এসে পড়েছি। শুটিং চলছে। অপেক্ষা করি। একটি দৃশ্য শেষ করে চঞ্চল চৌধুরী ফেরেন। গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। গলায় গামছা। পরনে লুঙ্গি (নাটকের পোশাক)। এসেই বললেন, ‘ও শরীফ, বস বস। বল কী বলবে?’ বলি, ‘আড্ডা দিতে এসেছি। আর আপনার সম্পর্কে কিছু জানব।’ বলে ওঠেন, ‘ও তাই, তাহলে আস বসি। শুটিং চলুক। তার ফাঁকে ফাঁকেই কথা সেরে নেব।’ তারকারা এভাবে কথা বলেন। ঘরের লোকের মতো। চমকে যাওয়ার জোগাড়। আমাদের আড্ডা শুরু হয় পাবনা থেকে, চঞ্চল চৌধুরীর জন্ম যেখানে।কেবল বাসভাড়া নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম
‘সাধারণ আর দশটা মানুষের মতোই আমার বেড়ে ওঠা। স্কুল ছিল পাবনাতেই। সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের উদয়পুর হাইস্কুলে পড়ি। তারপর রাজবাড়ি সরকারি কলেজে। ওখানে বোনের বাসায় থাকতাম। উচ্চমাধ্যমিকের পর ঢাকায় চলে আসি। আমাদের গ্রামটা ছিল সেক্যুলার একটা গ্রাম। বাবা রাধাগোবিন্দ চৌধুরী স্কুলের শিক্ষক। সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কাজ করতেন। এই ধরনের একটা সাংস্কৃতিক আবহের ভেতর দিয়ে আমার বেড়ে ওঠা।’
চঞ্চল বলেন শৈশবের কথা। তাঁর কথায় উঠে আসে, আজকে যে জায়গায় তিনি এসেছেন, তার বীজটা বোনা ছিল ওই গ্রামেই। তবে গানবাজনা আর অভিনয়ের মন্ত্রটা পেয়েছিলেন তাঁর বড় বোনের দেবর অপূর্ব কান্তি সাহার কাছে। তাঁর বড় ভাই ডাক্তারি পড়তেন। বাবা–মায়ের ইচ্ছা, চঞ্চল হবেন প্রকৌশলী। কিন্তু গানবাজনা আর ছাড়তে পারেননি তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন, এগুলো নিয়েই থাকবেন। চঞ্চল বলেন, ‘কলেজে পড়া অবস্থায় স্বপ্ন দেখি—হয় আমি শিল্পী হব, না হয় ছবি আঁকব বা অভিনয় করব। আমার আসলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে মন টানত না।’
চঞ্চল ঢাকায় আসেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে। সেটা ১৯৯৩–৯৪ সেশন। দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন বন্ধু রাহুল আনন্দ খবর দেন, আরণ্যক নাট্যদল লোক নেবে। যাত্রা শুরু অভিনয়ের। তারপর ১০ বছর কাজ করেন কেবল মঞ্চের পেছনে। সংক্রান্তি নাটকের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মঞ্চে অভিনয় করেন। মামুনুর রশীদ রচিত নাটক সুন্দরী। সেখানে সাংবাদিক চরিত্রে প্রথম ক্যামেরার সামনে আসা। তারপর চলে টুকটাক অভিনয়। এরই মাঝে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘মায়ের জন্য মোবাইল’ বিজ্ঞাপন দিয়ে যেন অন্য জগতে চলে এলেন। অভিনয়টা তখনো ছিল নেহাত মনের খোরাক। এই বিজ্ঞাপন যে তাঁকে পেশাদারির একটা স্রোতে ফেলে দেবে ভাবেননি চঞ্চল। একে একে গিয়াস উদ্দিন সেলিম, সালাউদ্দিন লাভলুসহ নামিদামী পরিচালকের নাটকে কাজ করেন। পরিচিতি বাড়তে থাকে। হয়ে ওঠেন তারকা।
প্রথম সিনেমা করেন তৌকির আহমেদের রূপকথার গল্প। কিন্তু দ্বিতীয় সিনেমা মনপুরা তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অন্য উচ্চতায়। একে একে করেন টেলিভিশন, মনের মানুষ, আয়নাবাজি, সবশেষ দেবী। একটানে জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকটা দেখে নিলেন চঞ্চল।
চঞ্চল চৌধুরীর চোখে কষ্টের দিনগুলো ভাসে। বলেন, ‘আমার মনে আছে। ঢাকাতে আমি শুধু বাসভাড়া নিয়ে এসেছিলাম। কত? ৩০০ বা ৪০০ টাকা। আমরা আট ভাইবোন। আমরা চার ভাইবোন তখন পড়ালেখা করি। চারজনের পড়াশোনার খরচ বাবার পক্ষে চালানো সম্ভব ছিল না। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বাবা কত টাকাই আর বেতন পান। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়েছে।’
এই সংগ্রামী জীবন পেরিয়েই আজকের চঞ্চল চৌধুরী। ঢাকায় এসে থাকতেন ভাইয়ের সঙ্গে। ভাই তখনো ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না। নিজের খরচের টাকাটা নিজেই জোগাড় করতেন টিউশনি করে। কিন্তু মঞ্চনাটকে কাজ করতে গেলে টিউশনিটা ঠিকঠাক করা যাচ্ছে না। এভাবেই চলছে। একটা পর্যায়ে অনার্স শেষ করে চাকরি নিলেন কোডায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন সেই কলেজে।
মায়ের জন্য মোবাইল: জীবনের মোড় ঘুরে গেল
প্রথম দিকে অনেক ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন চঞ্চল চৌধুরী। ধীরে ধীরে হাতে আসে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। চঞ্চল বলেন, ‘অসংখ্য নাটক করেছি। পাসিং ক্যারেক্টার। দূর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। চেহারাও ঠিকভাবে দেখা যেত না। ধীরে ধীরে অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পেয়েছি।’ এমন করে চলছে। একপর্যায়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁকে প্রস্তাব দেন একটি বিজ্ঞাপনের। সেটি ছিল ‘মায়ের জন্য মোবাইল’। এই বিজ্ঞাপন তাঁকে তারকাখ্যাতি পাইয়ে দিল। চঞ্চল বলেন, ‘এই বিজ্ঞাপনটা আমি করি ২০০৫ সালে। একটা বিজ্ঞাপন মানুষের এত কাছে যেতে পারে—এটা ছিল তার উদাহরণ। বিদেশে গিয়েছি। অনেক প্রবাসী বাঙালি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। বলেছেন, আপনার ওই বিজ্ঞাপনটা দেখে বুকের মাঝে কষ্টটা ধরে রাখতে পারি না।’
এমন নানা স্মৃতি লেপ্টে আছে বিজ্ঞাপনটির সঙ্গে। একদিন বাসে তাঁর পাশের সিটে বসা একজন তাঁর দিকে বারবার তাকাচ্ছেন। তখনো চঞ্চল অত পরিচিত নন। তবু ওই লোকটি চিনতে পেরেছেন যে চঞ্চল ওই বিজ্ঞাপনের অভিনেতা। লোকটির চোখ টলমল, কথা বলার চেষ্টা করেন। চঞ্চল বলেন, ‘কী ভাই। আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’ লোকটি তখন বলেছিলেন, ‘ভাই, আপনার অভিনীত বিজ্ঞাপনটা দেখেছি। আমি ছাত্র। আপনার বিজ্ঞাপনটা দেখার পর আমার টিউশনির টাকা জমিয়ে মায়ের জন্য একটা মোবাইল কিনেছি।’ চঞ্চল বলেন, ‘এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ল। সেটা ছিল আমার জীবনের অন্য রকম পাওয়া।’ফরীদি ভাই ও ভর্তার গল্প
এই অভিনয়যাত্রায় যেমন আছে সংগ্রামের গল্প, তেমন আছে ভালোবাসা, আবেগ, স্মৃতিরও কাহিনি। আমাদের আলাপে যাঁর স্মৃতি উঠে এল বেশি করে, তিনি কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। চঞ্চল চৌধুরী যাঁকে বলেন ‘ক্ষণজন্মা অভিনেতা’। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন, ‘ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে কাজের সুবাদে অনেক কথা হয়েছে। অনেক কিছু শিখেছি। কোনো নাটক উনি যদি পছন্দ করতেন, ফোন করে বলতেন। এরকম একদিন ফোন করে বলেন, “চঞ্চল, একটা নাটকে তোর মুখটা অনেক তেলতেলে লাগছিল।” আমি বললাম, “ফরীদি ভাই আমি তো মেকআপ ব্যবহার করি না। এই জন্য।” তিনি বললেন, “মেকআপ না ব্যবহার করলে সমস্যা নেই। তেলটা মুছে নিবি।” একটা স্মৃতির কথা মনে আছে। মনপুরা মুক্তির পর পয়লা বৈশাখের একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পাবনা যাচ্ছি। আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কি আজকে ঢাকায় আছিস?” আমি বললাম, “ফরীদি ভাই আমি তো ঢাকায় নাই। পাবনা যাচ্ছি।” ফরীদি ভাই বলেন, “একদিন শুটিংয়ে বলছিলি, ভর্তা নাকি তোর পছন্দ। আজকে তুই আমার বাসায় আসবি।” আমি বললাম, “আমার তো অনেক রাত হবে।” তিনি বললেন, “তোর যত রাত হোক বাসায় আসবি। তোর জন্য কয়েক রকমের ভর্তার আয়োজন করছি। খাবি তুই!” আমি রাত প্রায় ১টার দিকে তাঁর বাসায় যাই। গিয়ে দেখি, তিনি জেগে আছেন। ডাইনিং টেবিলে অন্তত ২৫ রকমের ভর্তা নিয়ে ফরীদি ভাই বসে আছেন অতিথিসৎকারের জন্য।’কিছু দুঃখ, কিছু আশা
এখন যেসব নাটক বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই নিম্নমানের। পেশাদারি জায়গাটার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। টেলিভিশনের জায়গা নিচ্ছে অনলাইন, অনেক সৃষ্টিশীল মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। সম্মিলিতভাবে এ শিল্পের সবাই ভালো না থাকলে এটা মুখ থুবড়ে পড়বে। এটা কষ্ট দেয় চঞ্চলকে।
হতাশ হয় যখন মন, তখন টিকে থাকার শক্তি পান রবীন্দ্রনাথেই। ছোটবেলায় রবিঠাকুরের গান মনে হতো একঘেয়ে, এইচএসসির পর থেকে বুঝতে শুরু করলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের গানই বড় সহায়। যখন চারদিক দেখে ক্লান্ত হয় মন, তখন আশ্রয় ওই রবীন্দ্রনাথই—‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’।
‘মায়ের জন্য মোবাইল’ থেকে দেবীর ‘মিসির আলি’ পর্যন্ত পৌঁছাতে যে পথ পাড়ি দিয়েছেন চঞ্চল, তা নিষ্ঠা, সততা, দক্ষতার। এই পথ ধরেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।