প্রত্যয় হামিদ :: নজরুল ইসলাম। নওগাঁর একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছেলেকে ভর্তি করানোর জন্য এক সকালে তিনি রওনা দিলেন বাউয়েটের উদ্দেশে। কিন্তু ভাবতেই পারেননি, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম এতজনের কাছে শুনে এসেছেন তিনি, তা শহর থেকে এত দূরে! যাত্রাপথে কোনো হাইওয়ে পাননি। পেরিয়েছেন কেবল সরু গ্রাম্য আঁকাবাঁকা রাস্তা। সবুজের মায়ায় আচ্ছন্ন সে রাস্তাগুলো ধরে আসার সময় তাঁর মনে হচ্ছিল, এ কোথায় যাচ্ছেন তিনি! কিন্তু যখন ক্যাম্পাসের মেইন গেট পার হলেন, তাঁর মনে হলো যেন হঠাৎই কোন জাদুবলে ঢুকে গেছেন এক স্বপ্নরাজ্যে। রাস্তায় যে সামান্য ক্লান্তিটুকু জমেছিল, মুহূর্তেই তা উবে গেল। আহ, এত সুন্দর একটি ক্যাম্পাস যেন গ্রামীণ জনপদে এক টুকরো অন্য আলো, অন্য জগৎ। সাজানো গোছানো, ছিমছাম। ছাত্রছাত্রীদের দুরন্ত পদচারণে মুখরিত চারপাশ। তারুণ্যের চোখেমুখে উজ্জ্বল আর সম্ভাবনাময় আগামীর বাংলাদেশকে দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। অবশেষে নিজের সিদ্ধান্তকে নিজেই কুর্নিশ করলেন। পেলেন প্রগাঢ় তৃপ্তি।
শুধু নজরুল ইসলামই নন। নাটোর শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্টের পেছনের এই অংশে স্থানীয় যে জনগণের বাস, তারা এই তিন বছর আগেও ভাবতে পারেননি, এ রকম একটা ‘হঠাৎ জেগে ওঠা’ ক্যাম্পাস তাদের এই ‘বিলপাড়া’য় কোন দিন সৃষ্টি হতে পারে! ধরুন, এ এলাকার যে মানুষটি বছর চারেক আগে বিদেশ গেছেন, তিনি যদি এই ডিসেম্বরে ফিরে আসেন, রীতিমতো হতভম্ব হবেন; প্রথম ধাক্কায় ভাববেন, নিশ্চয় তিনি কোনো ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন! অতএব আপনার মনে হতেই পারে, ‘Let there be light, and there is light’’-এর আধুনিক সংস্করণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাউয়েট- ‘Let there be buildings, and there are buildings.’ কী জানি, তাই হয়তো! নজরুল ইসলামও মনে মনে ভাবলেন। আর্মি, বাংলাদেশ আর্মি বলে কথা। তাদের তত্ত্বাবধানেই তো পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বাউয়েট)। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর যাত্রা। এই অল্প সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়টি যে অবস্থানে উঠে এসেছে, তা অবকাঠামোগত বিবেচনায় বাংলাদেশে বিরল এক দৃষ্টান্ত।
এবার ক্যাম্পাসটা একটু ঘুরে দেখা যাক। গেট থেকে সামনে এগোলেই গাড়ি পার্কিং। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বাসসহ বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাস যেন হুকুমের অপেক্ষায় প্রস্তুত করে রেখেছে নিজেদের। গেটের ডান পাশে বাউয়েট ক্যাফে। তার পেছনেই ক্যান্টনমেন্ট লেক। লেকের ধারে বেশ কিছু ছাতাছাউনি। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা-আড্ডা চলে বিকেলে, সন্ধ্যায়।
পার্কিংয়ের সামনে আটতলা ছাত্র হল। নাম বড়াল। নাটোরের বড়াল নদকে স্মরণ করেই রাখা হয়েছে নামটি। হলের সামনেই অভিভাবক অপেক্ষাগার। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে এলে অথবা বেড়াতে এলে অভিভাবকেরা যেন নিজেদের মতো করে একটা বসার জায়গা পান, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। সেটা পার হয়ে গেলে একটি পুকুর। পুকুরের পূর্ব পাড়ে ‘ফ্যাকাল্টি অ্যান্ড অফিসার্স পয়েন্ট’। সেটার সঙ্গে একটা স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম। এখানে সাধারণত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হয়ে থাকে।
পুকুরসংলগ্ন যে উন্মুক্ত মাঠ, তা যুক্ত করেছে শিক্ষাভবন এবং ছাত্রী হল। (ছাত্রী হলের নাম ‘বনলতা’, যা প্রত্যাশিতই।) এই হলের দ্বিতীয় তলাটি ফ্যাকাল্টি-অফিসার্স মেস কমপ্লেক্স। ওয়াই আকৃতির মূল শিক্ষা ভবনটির দুটি অংশ প্যানোরমা ও নেক্সাস লিফট দিয়ে যুক্ত। ‘ওয়াই’-এর মধ্যখানে আছে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। ভবন দুটির সামনে বাউয়েট প্লাজা, যা পুরকৌশলের এক অনন্য সৃষ্টি। এ ভবনের সামনে খেলার মাঠ। এক পাশে আরেকটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা শহীদ মিনার ও বিজয় টাওয়ার। রাতের বেলা এই টাওয়ার অসাধারণ রূপ নিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের রংকেই তুলে ধরে।
এই অতি অস্বাভাবিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বাউয়েট) প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের উন্নয়নকেও প্রতিনিধিত্ব করে। যে ক্যাম্পাস যাত্রা শুরু করেছিল ক্যান্টনমেন্ট পরিচালিত একটি স্কুলমাঠের তাঁবুতে, তা মাত্র দেড় বছর বয়সে নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়েছে। পরের দুই বছরের মধ্যেই এই ক্যাম্পাসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে আট ও ছয়তলা দুটি একাডেমিক ভবনসহ প্রয়োজনীয় প্রায় সব অবকাঠামো। দরকারি ল্যাবসহ পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ আছে, যা প্রায় ২০০০ ছাত্রছাত্রীকে একসঙ্গে পাঠদানের সুযোগ দেবে।
২০ বিঘা সামরিক জমিতে তৈরি হয়েছে বর্তমান অবকাঠামো। এ ছাড়া বাউয়েট নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে কিনেছে আরও প্রায় ১৫ বিঘা জমি। সেখানেও নির্মিত হবে শিক্ষার্থী হল, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা, ভিসির বাসভবন এবং খেলাধুলার জন্য একাধিক মাঠ। এ রকম পরিকল্পনার কথাই জানালেন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোস্তফা কামাল। জানালেন, শিগগিরই সেসব কাজ শুরু হবে। প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এইচ এম শহীদউল্লাহর হাত ধরে যে বিরল উন্নতির সূচনা, তা অব্যাহতভাবে ঊর্ধ্বমুখী রাখার প্রত্যয় নিয়েই কাজ শুরু করেছেন বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর। তাঁর দৃঢ় প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সহযোগিতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় খুব অল্প দিনেই বাউয়েট দেশের সেরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
২.
বিকেলের মায়াবী রোদ ঠেলে নজরুল ইসলাম যখন ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালেন, দেখলেন পুকুরের চারপাশেই কেবল নয়, মাঠে, স্মৃতি অম্লানের (শহিদ মিনার ও বিজয় টাওয়ার) পাদদেশসহ সারা ক্যাম্পাসে আড্ডার ফুলঝুরি। একদল শিক্ষার্থী গিটারে এলোমেলো সুর তুলছে। বন্ধুরা সুরে, বেসুরো গলা মেলাচ্ছে সেই গিটারের সঙ্গে।
মেইন গেট থেকে বের হতেই আবার সেই আঁকাবাঁকা গ্রাম্য রাস্তা। একটিমাত্র প্রাচীর যেন দুটি আলাদা জগতের বিভাজনরেখা। একই সঙ্গে গ্রাম আর শহরকে উপভোগ করার এই সুযোগ দেশের আর কোথাও পাওয়া যায় কি না, নজরুল ইসলাম তা-ই ভাবছিলেন। ভাবতে ভাবতেই পেরিয়ে গেছেন অনেকটা পথ। পেছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন, গ্রামের সবুজ সৌন্দর্য ভেদ করে এক মোহনীয় রূপ অঙ্গে মেখে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে বাউয়েট।