কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো একেকটা পরিবারের মতো। এখানে সবাই মিলে কিংবা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সাহ্রি ও ইফতার করেন। শুনুন কয়েকটি হলের গল্প
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হল একটা পরিবার
মাহবুব আলম
সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে। সাহ্রি ও ইফতারের সময় হলের বাসিন্দারা যেমন মা-বাবা-ভাই-বোনকে মিস করেন, তেমনি ঈদের আগে বাড়ি চলে গেলে মিস করেন হলের বন্ধুদের। দুটোই তো পরিবার।
হলের সাহ্রি ও ইফতার হয় দল বেঁধে। ছোট-বড়দের মধ্যে একটা আত্মার বন্ধন সৃষ্টি হয় এই সুযোগে। বাড়ি ছেড়ে হলে থাকা শিক্ষার্থীরা তখন ভুলে যান দূরে থাকার কষ্ট। কথা হচ্ছিল হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের বাসিন্দা, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র মিরাজ হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘হলের ডাইনিংয়ে আমরা সাহ্রি করি সবাই মিলে। হয়তো মা-বাবা, ভাই-বোনদের সঙ্গে খাওয়ার আনন্দটা পাচ্ছি না। কিন্তু হলের মানুষগুলোও আমার দ্বিতীয় পরিবার।’
সাহ্রিতে যেভাবে একসঙ্গে সবাইকে খেতে দেখা যায়, ইফতারে ঠিক তার উল্টোটা চোখে পড়ে। কেউ রুমমেটদের সঙ্গে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে, আবার কেউ ছোট অথবা বড় ভাইদের নিয়ে ইফতার করেন। প্রায় প্রতিদিনই হলে বিভিন্ন জেলা বা উপজেলাভিত্তিক সংগঠনগুলো ওই অঞ্চলের ছাত্রদের জন্য ইফতারের আয়োজন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগও একই রকম আয়োজন করে থাকে। হলে ইফতার করা নিয়ে ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের ছাত্র সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘হলের ইফতার আমি বেশ উপভোগ করি। একেক দিন একেক জায়গায় একেক দলের সঙ্গে ইফতার করা হয়। এমনকি হলের ছাদেও কখনো কখনো আমরা ইফতারের আয়োজন করি। ভালো লাগে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
আয়োজন হয় একসঙ্গে
মোস্তফা মনোয়ার
রাত আড়াইটার দিকে ঢং ঢং করে বেজে ওঠে ঘণ্টা। কেউ হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কেউ অ্যাসাইনমেন্ট বা ল্যাব রিপোর্ট তৈরি করছিলেন, কেউবা পড়ে নিচ্ছিলেন ক্লাস টেস্টের পড়া। সাহ্রির সময় সবাই একসঙ্গে চলে আসেন হলের ডাইনিংয়ে। রুমমেট কেউ যদি ঘুমিয়ে থাকেন, তাঁকে ডেকে তোলেন অন্যরা। সাহ্রিতে বুয়েটের হলগুলোতে সাধারণ খাবারের সঙ্গে বাড়তি হিসেবে দেওয়া হয় এক পেয়ালা দুধ আর একটি করে কলা। কেউ চা খেতে চাইলে সেই ব্যবস্থাও আছে। ডাইনিংয়ের বাইরে হলের ক্যানটিন বয়েরা চা-বিস্কুট নিয়ে বসে থাকে আগে থেকেই।
ক্লাস-ল্যাব শেষ হতে হতে বেজে যায় বিকেল পাঁচটা। সাহ্রিতে হলে আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও ইফতারির ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়। রুমে রুমে নিজেরাই ইফতারের আয়োজন করেন শিক্ষার্থীরা।
কাজগুলো ভাগ করে নেওয়া হয় আগেই। কেউ বাইরে চলে যান ছোলা, মুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজি, বুন্দিয়া, জিলাপি, চপ, শসা বা লেবু কিনতে। কেউ তৈরি করেন শরবত। কারও ওপর দায়িত্ব পড়ে সালাদ তৈরির। নেওয়া হয় বিশাল এক গামলা। তাতে একসঙ্গে ঢেলে দেওয়া হয় ইফতারের জন্য যা যা আনা হয়েছে, সবকিছু। এরপর কেবল মাখাও। এদিকে হয়তো ইফতারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে, কেউ কেউ তাড়া দিতে থাকেন। কেউ আবার কাজে হাত না লাগালেও তদারকিতে বেশ পটু। ‘তাড়াতাড়ি কর…এখনো শরবত বানানো হলো না তোদের…শসা কেউ এভাবে কাটে…বুন্দিয়াগুলো বোধ হয় পুরোনো…’ শোনা যায় নানা মন্তব্য। সময়মতো হলের মসজিদের ইমাম ঘোষণা করেন, ‘ইফতারের সময় হয়েছে, সবাই ইফতার করে নিন।’ দেখতে দেখতে বিশাল গামলাটা খালি হয়ে যায়। একদিন হল ছেড়ে চলে গেলে নিশ্চয়ই এই ইফতারের জন্য শিক্ষার্থীদের মন কাঁদবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ভিড় জমে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে
সাহিব নিহাল
রোজার সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় জমে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে গোল হয়ে বসে ইফতার করার ‘ঐতিহ্য’ অনেক পুরোনো। এ বছরের চিত্রও ভিন্ন নয়। বিকেলের দিকে মাঠের দিকটায় গেলে দেখা যায় ছোট ছোট জটলা। কেউ হয়তো ইফতারের খাবার কিনতে যাচ্ছেন, কেউবা খাবার সাজাচ্ছেন। নিজেদের মতো দল বেঁধে বসেছেন অনেকজন।
এখন রোজার বন্ধ চলছে বলে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা কম। যেসব বিভাগের পরীক্ষা শেষ হয়নি, সেসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা এখনো ক্যাম্পাসে আছেন। যাঁরা টিউশনি করান, তাঁদেরও হলে থাকতে হচ্ছে। এখানকার শিক্ষার্থীদের একটা প্রিয় জায়গা হলো বটতলা। অনেক শিক্ষার্থী হলে সাহ্রি করলেও একটা বড় অংশকে বটতলায় সাহ্রি করতে দেখা যায়। আবার কোনো কোনো হল থেকে বটতলার দূরত্ব বেশি হওয়ায় সাহ্রির সময় সবাই সেখানে গিয়ে খেতে পারেন না। তাই হলের মেসগুলোতেও ভিড় বাড়ে।
ছেলেদের সাহ্রির একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। সমস্যা হয় মেয়েদের। হলের গেট বন্ধ থাকে। অনেক হলে খাবার পাওয়া যায় না। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থী সপ্তর্ষি আহসান বলছিলেন, ‘আমাদের হলে কেউ রাতে ফেরার সময় খাবার কিনে আনে, কেউ দুপুরে ক্যানটিনে লিখে আসে, ওদের জন্য রান্না হয়। আবার আমার মতো অনেকেই নিজে রান্না করে।’ এসব সমস্যার কথা মাথায় রেখে ক্যাম্পাসেরই এক শিক্ষার্থী হাতে নিয়েছেন হলে হলে গিয়ে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ! সাহ্রির সময় নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে প্রতি হলের গেটে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি।
‘নিজেদের মতো সাহ্রি-ইফতার করা ছাড়াও প্রতিবছর বিভিন্ন সংগঠন, জেলা সমিতি কিংবা বিভাগের পক্ষ থেকে ইফতারের আয়োজন করা হয়। গত বৃহস্পতিবার আমাদের সংগঠনের আয়োজন ছিল। তার আগে থিয়েটার, জলসিঁড়িসহ আরও অনেকেই আয়োজন করেছে,’ জানালেন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশনের সভাপতি মুশফিক উস সালেহীন।