ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী ।। ১৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯, স্নেহাস্পদ শহীদ নাহিদের ২৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী ।দেখতে দেখতে চোখের পলকে ২২ টি বছর পেরিয়ে আজ ২৩ বছরেপদার্পন করলো । কালের প্রবাহ আর সময়ের আবর্তে অনেককিছুবিলীন হয়ে যায়, হয়তো নাহিদের স্মৃতিও একদিন বিলীন হয়ে যাবে। যতদিন যাচ্ছে ততই স্মৃতির মলাটে মরিচিকা জমাট বাঁধছে, কিন্তু আমার হৃদয় থেকে সে কখনো হারিয়ে যায়নি। কেন যেন মনে হয় তাঁর সাথে আমার আত্মার একটি সম্পর্ক ছিল আর সে জন্য তাঁর এই অকাল মৃত্যুর জন্য নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয়। ইচ্ছে করলে হয়তো সে আরো অনেকদিন বাঁচতে পারতো। কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র আর মানুষের মৌলিক আর ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে তাঁকে আত্মাহুতি দিতে হলো। নাহিদ বিশ্বাস করতো জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তা ছিলো মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন। সুতরাং সেই আন্দোলন বাস্তবায়িত করার জন্য যা করার দরকার তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল।
শহীদ নাহিদ
নাহিদ সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কিছু বলা যাবে। আমরা একই গ্রামের। বয়সে আমার থেকে ৩/৪ বছরের ছুটো হবে।অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র এবং খুব মিশুক স্বভবের ছিল। সবার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে বিয়ানীবাজার থানা সদরে। আর সেজন্য গ্রামের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো না। তবে গ্রামকে খুব ভালোবাসতাম। স্কুল বন্ধ হলে প্রায়ই চলে আসতাম গ্রামে। সেই সুবাধে গ্রামের সমবয়সী ছেলেদের সাথে খুব হৃদ্যতা না থাকলেও মুটামুটি ভালো জানাশুনা ছিল। ১৯৯২ সালে মেট্রিক পরীক্ষার পর গ্রামে একেবারে চলে আসি। আমার খুব মনে পড়ে তখন শীতকাল ছিল। গ্রামের সবাই মাঠে ক্রিকেট খেলতে যেথাম। নাহিদ ছিল ক্রিকেট পাগল। আরো সবার সাথে তখন শুরু হলো ক্রিকেট খেলা। নাহিদের ব্যাট, বল সহ ক্রিকেটের সকল সরঞ্জাম ছিল। আমি খেলা ধুলায় কোন দিনও খুব ভালো ছিলাম না।ক্রিকেটের ব্যাটিংটা আমার খুব পছন্দ ছিল, কিন্তু যখনি ব্যাটিং করতে যেতাম নাহিদের বলে প্রায়ই স্ট্যাম্প বোল্ড অথবা কেচ। সাথে সাথে তখন ঝগড়া লাগিয়ে দিতাম। বোল্ড হয়নি বলে। প্রায়ই নাহিদকে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয়বার বল করতে হতো। এখনো মনে হলে একা একা হাসি।
আমার বাড়ি পার হয়ে নাহিদের বাড়ি। তার একটি সাইকেল ছিল। প্রায়ই সাইকেল নিয়ে বাজারে যেত। রাস্তায় দেখা হলে সাইকেল থেকে নেমে হেটে হেটে আমাদের সাথে যেত। খুব রাজনীতি সচেতন ছিল এবং প্রতিদিনের রাজনীতির উপরও তার খুব আগ্রহ ছিল। প্রায়ই তার সাথে রাজনৈতিক সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা হতো। একদিকে যেমন তার দলের প্রতি আনুগত্য ছিল, অন্যদিকে ঠিক তেমনি দলের গঠন মূলকসমালোচনাও সে করতো। দলের স্থানীয় অথবা কেন্দ্রীয় কোন দৃষ্টিকটু বিষয় দেখলে অথবা শুনলে আমাকে সে প্রায়ই প্রশ্ন করতো এটা কেমন হলো অথবা এটা অন্যভাবে কেন হলোনা। আমি প্রায়ই হেসে হেসে বলতাম লিডার সব কিছু বুঝবে না। তখন সে হেসে হেসে বলতো লিডার তো আমি না আপনি। প্রায়ই তাকে মজা করে লিডার বলতাম, আর শব্দটি শুনলেই প্রতি উত্তরে এই একই কথা বলতো।
১৯৯২ সালে আমি বিয়ানীবাজার কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। কলেজে তখন সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। এই সুবাধে বন্ধু শাহাব উদ্দিন (মিশিগান আলীগের সেক্রেটারি), মান্না (বর্তমানে কুয়েত প্রবাসী), সুহেল ভাই (বর্তমানে ফ্রান্স) আর আহাদ (নাহিদ স্মৃতি পরিষদের সভাপতি) এবং ইকবাল (বর্তমান চারখাইইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক)। কবির ভাই আর বাহার ভাই তখন স্থানীয় ছাত্ৰলীগের নেতা ছিলেন। আর তখন আমাদের স্থানীয় আলীগ নেতা ছিলেন মাহমুদ আলী ভাই (বর্তমান চেয়ারম্যান) আর মইনুল ইসলাম তখনকার চারখাই ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি।বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকার আন্দোলন। আমরাও তখন আস্থে আস্থে সংঘটিত হতে থাকি। আমার মনে আছে আমরা প্রায়ই ইউনিয়ন আলীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের উদ্যোগে মিছিল মিটিং করতাম।
তখনকার সময় অন্যান্য ইউনিয়নের তুলনায় আমাদের এলাকায় আন্দোলন একটু ভালো জমতো। তার পেছনে ভৌগোলিক কারণও ছিল। আমাদের এলাকা হলো বিয়ানী বাজার, গোলাপগঞ্জ, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ এবং সিলেট সদর থানার ঠিক মধ্যে খানে। সুতরাং হরতাল বা বিক্ষোভ মিছিল আমাদের এলাকায় হলে চুতুর্দিকে খুব সহজে প্রচার হতো। তখনকার সময় সরকার বিরোধী আন্দোলন হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ সহ অনেক কর্মসূচি নিয়মিত ভাবে থাকতো। আমরা ও কেন্দ্রের সাথে প্রায় সকল ডাকে সাড়া দিতাম। হরতালের সময় কাক ডাকা ভোরে সবাই মিলে পিকেটিং করতাম। অন্যান্য সবার সাথে নাহিদ ও নিয়মিত উপস্থিত থাকতো। আমাদের অনেকের থেকে সে বাজারে আগে চলে আসতো। মিছিলের প্রতিও ছিল তার গভীর আগ্রহ। তখন সরকার বিরোধী আন্দোলনের সাথে সাথে যুক্ত ছিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন। আমরা নির্মূল কমিটির কর্মসূচিগুলোও পালন করার চেষ্টা করতাম। মিছিল–মিটিং শেষ করে একসাথে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন নাহিদ প্রায়ই কয়েকটি প্রশ্ন করতো – আলীগ কি কোন দিন ক্ষমতায় যেতে পারবে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার কি কোন দিন হবে? জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যা এবং তার হত্যাকাণ্ডের বিচার রোধকরার জন্য ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স, তার দৃষ্টিতে ছিল এক চরম জঘন্য অপরাধ। আক্ষেপ করে বলতো এটা কি করে সম্ভব? জিজ্ঞেস করতো ভাই, আমাদের জীবদ্দশায় কি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে? বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ট সন্তান রাসেলকে নিয়ে তার খুব কষ্ট ছিল। প্রায়ই বলতো বুঝলাম অন্যরা না হয় দোষ করেছে কিন্তু এই মাসুম বাচ্চাটি কি করেছিলো? তাকে কেন হত্যা করা হলো? একবারও কি হত্যাকারীদের হাত কাঁপলোনা?
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটির আন্দোলনে সে সক্রিয় ছিলো। তবে এর বিচার নিয়ে তার মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। তখনকার জামাত আর ছাত্র শিবিরের রাজনৈতিক, অবস্থান, কার্যক্রম, বেপরোয়া আচরণ, ক্ষমতার অংশীদারিত্ব আর রাজনৈতিক পুনর্বাসন বিষয়গুলো নিয়ে প্রায়ই তার সাথে আলাপ হতো। সে প্রায়ই বলতো অদৌ এদের বিচার কি সম্ভব? আমিও অনেক সময় তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতাম হয়তো সম্ভব হবেনা। তবে সে বিশ্বাস করতো এই অপরাধীরা একদিন বিচারের আওতায় আসবে এবং এই হত্যার বিচার একদিন বাংলাদেশে হবে।
আজ নাহিদ নেই। ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলি নাহিদ – আলীগ ক্ষমতায় গিয়েছে, বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছে, শুধু যোদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করিনি, বিচারের রায় কার্যকর করেছি। শুধু আফসুস তুই জীবন দিলে কিন্তু তোর এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারলে না।
সম্ভবত ১৯৯৪ সালে নাহিদ সহ আরো বেশ কয়েকজন তার সহপাঠী আমাদের সাথে সক্রিয় হয়। তখন তারা মেট্রিক পরীক্ষা শেষ করে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে বেলায়েত, আবু সুফিয়ান, দুলুসহ আরো অনেকে। তখন ইউনিয়ন ছাত্ৰলীগের কার্যালয়ে প্রতি মাসে মিটিঙে বসতাম। মিটিং আনুষ্টানিকভাবে হতো এবং সবাইকে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে হতো। তখন প্রতি মিটিংয়ের আগে আমি নাহিদকে বক্তব্য লিখে দিতাম। নাহিদ প্রায়ই সে বক্তব্য পড়তো। এখনো চোখে ভাসে নাহিদ মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছে আর তার হাত কাঁপছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৯৬ সাল জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি ছিল খুব কঠিন সময়। মাগুরা উপনির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাদেশ তখন উত্তাল। অন্যদিকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে সরকার কার্যত দিশেহারা এবং একঘরে। ঠিক এমনি সময়ে তৎক্ষালীন বিএনপি সরকার ঘোষণা করলেন জাতীয় নির্বাচন, তারিখ ছিল ১৫ই ফেব্রুয়ারী। আমরা তখন খুব সক্রিয় ছিলাম প্রায় প্রতিদিন মিছিল মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। স্থানীয় পর্যায়ে থানা সদরের পরে আমাদের ইউনিয়নে তখন অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি আন্দোলনে বেশি সক্রিয় ছিল। থানা ছাত্ৰলীগের আহবায়ক ছিলেন আব্দুল বারী, যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হুসেন, আউয়াল ভাই, আব্বাসভাই সহ অনেকে। তার মধ্যে বিয়ানী বাজার কলেজের ভিপি ছিলেন হেলিমুল হক অন্যতম। অন্যদিকে সিলেট জেলা আলীগের যুগ্মসম্পাদক, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রয়াত আব্দুল খালিক ভাই প্রায়ই আমাদের এলাকায় আসতেন। মূলত তারাই ছিলেন আমাদের মূলচালিকা শক্তি। স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি তাদের সাথে আমাদের যুগসূত্ৰ ছিল। মিছিলের প্রতি তার ছিলো খুব আগ্রহ। প্রায়ই মিটিংয়ের পরে নাহিদ ও তার সাথীদের চাপ থাকতো মিছিলের। প্রায়ই হরতালের সমর্থনে আমরা আগেরদিন সন্ধ্যায় মশাল মিছিল দিতাম। এখনো চোখে ভাসে তার কি আগ্রহ। মশাল জ্বালানোর জন্য বাঁশের লাঠি ও তেল সংগ্রহ অতঃপর মিছিল। সে খুব পছন্দ করতো।
ফেব্রয়ারীতে নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো আন্দোলন তখন আরো সক্রিয় হয়ে উঠছিলো। প্রায় প্রিতিদিন টানা হরতাল অবরোধ মিছিল মিটিং হতো। আমাদের মধ্যেও এক প্রকার উত্তেজনা কাজ করছিলো। তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তখন প্রায় সব রাজনৈতিক সংগঠন এক হয়ে গিয়েছিলো। বিএনপি সরকার তখন যে করেই হোক একটা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আর অন্যদিকে আলীগ সেই নির্বাচনকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। আমার মনে হয় ১০ কিংবা ১১ তারিখ ধর পাকড় শুরু হয়। আর তখন শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার নামে সেনা বাহিনী প্রায় প্রতিটি জায়গায় টহল দেয়া শুরু করে। আমার বড় ভাই তখন রাশিয়াতে থাকেন। ১২ তারিখ উনার একটি বিশেষ কাজে আমাকে ঢাকায় রাশিয়ান এম্বাসিতে যেতে বলেন। আমার প্রয়াত বাবা শুধু আমাকে ডেকে ঐ দিন সকাল বেলা বলেন এবং ২/১ দিনের মধ্যে ঢাকা যেতে বলেন। সেদিন সম্ভবত হরতাল ছিল আমি তখন বাবাকে বলেছিলাম এর পরের দিন যাবো। চলমান আন্দোলন আর যোগাযোগব্যবস্থার কথা বিবেচনা করে যেতে মন চাচ্ছিলোনা। কিন্তু বাবা রাজি হলেন না। বাবার কথা হলো যেকোন ভাবেই হোক আমি যেন ঐ দিনই ঢাকায় রওয়ানা হই। সম্ভবত বাবার ও ইচ্ছা ছিলো ঐ সময়টা অন্তত বাড়িতে না থাকি। তাই বাবার চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। তখন সকাল বেলা। বাবাকে কথা দেই, বিকাল বেলা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবো। বাবার সাথে কথা শেষ করে বাজারে চলে যাই। বাজার থেকে দুপুর প্রায় ২ টার দিকে বাড়ি ফিরছিলাম, তখন গাড়িতে উঠতেই পেছন থেকে মনে হলো নাহিদ আমাকে ডাকছে। পেছন ফিরে থাকাতেই দেখি নাহিদ। সালাম দিয়ে সরাসরি প্রশ্ন – ভাই আপনি নাকি ঢাকা যাচ্ছেন? আমি তখন হটাৎ চমকে গেলাম। কারণ ঢাকা যাবো, কথাটি আমি আর আমার বাবা ছাড়া অন্য কারো কাছে হয়নি। সুতরাং নাহিদ কেমন করে জানলো? আমি তখন উত্তরে বললাম না আমি তো ঢাকা যাচ্ছিনা, তাকে আবার প্রশ্ন করলাম তুমি জানলে কেমনে? তখন উত্তরে বললো, আমি যেভাবেই হোক জেনেছি, আপনি যাচ্ছেন কিনা সেটা বলুন? আমি তখন একটু জোরগলায় বললাম, না আমি যাচ্ছিনা। তখন সে বললো, দেখেন ১৫ তারিখ নির্বাচন এবং যেভাবেই হোক এই নির্বাচন আমাদের বন্ধ করতে হবে। আপনাদের মতো নেতারা যদি না থাকেন তাহলে কেমন করে হবে। আমি তখন হাসি মুখে বললাম – না লিডার আমি আছি, তখন সে আবার উত্তরে বললো, আমি না আপনি লিডার। আর সবশেষে আমাকে বললো – কালাম ভাই যেখানেই যান ১৫ তারিখ যেন আপনাকে আমি চারখাইতে পাই। আমি তখন উত্তরে বললাম, অবশ্যই পাবে। এই ছিল তার সাথে আমার জীবনের সর্বশেষ কথা। এখনো মনে পড়ে ১৫ তারিখের নির্বাচনকে ঘিরে তার মধ্যে যেন এক অন্যরকম আগ্রহ ছিলো।তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমার সাথে তার যে শেষ কথা হয়, ঐ কথাগুলোর ভাব বা ভঙ্গি ছিল একটু ব্যতিক্রম। ঐ দিনের তার কথার মধ্যে কোন অনুরোধ ছিলোনা বরং কেমন যেন একটা আদেশের মতো সুর ছিলো। আমি ১৩ তারিখ রওয়ানা দিয়ে ঢাকা চলে যাই। খুব ইচ্ছা থাকলেও ১৫ তারিখ বাড়ি ফেরা হয়নি। হরতাল, অবরোধ আর পিকেটিংয়ের জন্য ঢাকা থেকে ফেরা ছিল খুবই দুস্কর। সেজন্য ১৪ ও ১৫ তারিখ ছিলাম ঢাকায় হেলিম ভাইয়ের বাসায়। ১৫ তারিখ রাতে চলে যাই ফকিরাপুল উদ্দেশ্য এলাকার খবর নেয়া। রাতে আমি আর হোচিমিন (হেলিম ভাইয়ের ছুটো ভাই) গেলাম ক্যাপিটাল হোটেলে সেখানে বিয়ানীবাজারের উপজেলা চেয়ারম্যান মুজাম্মিল আলীও ছিলেন। তখন খবর পেলাম চারখাইতে একজন মারা গেছেন। কিন্তু তার নাম পরিচয় কেউই দিতে পারছিলেন না। রাতে বাসায় ফিরে হেলিম ভাইয়ের সাথে কথা হয়।হেলিম ভাইও তখন বললেন উনিও পরদিন সিলেট যাবেন। সারারাত ছটফট করছিলাম, মোটেও ঘুমাতে পারিনি। সকাল বেলা খুব ভোরে উঠে জনকণ্ঠ পত্রিকায় দেখলাম নাহিদের নাম। বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তারপর সকাল বেলার ট্রেনে চলে আসি সিলেট। আর বাড়িতে আসতে আসতে তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিয়ে যখন নাহিদের পারিবারিক গোরস্থানে যাই, তখন সব শেষ। নাহিদের কবরের মাটি ততক্ষনে ভরাট হয়ে গেছে। শেষ বারের মতো নাহিদের মুখও দেখা হলোনা। নাহিদকে দেয়া কথা রাখতে পারি নাই। হয়তো সেজন্য তাকে শেষ বারের মতো দেখাও হয়নি।
নাহিদ সম্পর্কে অনেক কিছুই বলার আছে, আমি যে নাহিদকে দেখেছি সেছিলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ বাস্তবায়নের একনিষ্টকর্মী। কোন লোভ লালসার মোহের জন্য সে রাজনীতি করে নাই। সে রাজনীতি করতো কারণ সে বিশ্বাস করতো তার রাজনীতিই বাস্তবায়ন করতে পারে সাধারণ মানুষের অধিকার। সে বিশ্বাস করতো শেখ হাসিনার সেদিনের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ছিলো, এদেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবন মরণের সংগ্রাম। সুতরাং যেভাবেই হোক এই সংগ্রামে জয়ী হতেই হবে আর এজন্য তাকে যতটুকু ত্যাগ স্বীকার করা দরকার তার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো। নাহিদের মতো অসংখ্য মানুষ স্বাধিকার, স্বায়ত্ব শাসন আর স্বাধীনতা সংগ্রামে যুগে যুগে আত্মত্যাগ করেছে। কিন্তু তারপর ও আমাদের কাঙ্খিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। তাই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নামে বেনামে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ভোটাধিকার কিংবা গণতান্ত্ৰিক আন্দোলনের নামে তাদের আত্মহুতি প্রতীয়মান। বর্তমান যুগের নেতা নেত্রীদের কাছে নাহিদের রাজনীতি খুবই প্রয়োজন। নাহিদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু জানার এবং বুঝার আছে। নাহিদ জীবন দিয়ে প্রমান করে গেছে রাজনীতি পকেট ভারী কিংবা নাম আর খ্যাতির জন্য নয় বরং রাজনীতি মানুষের জন্য। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। পরিতাপের বিষয় নাহিদদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে যুগে যুগে ক্ষমতার পালা বদল হয় সত্য কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা কিছুই শিখিনা। বরং আমরা বার বারই নাহিদদের বলি আমাদের কাছ থেকে শিখার। নীতি আর আদর্শহীন রাজনীতি দিয়ে দেশ ও সমাজ গড়া যায়না। দেশ ও সমাজ গড়তে হলে নাহিদের মতো নির্লোভ হতে হবে, আর তবেই কেবল বঙ্গবন্ধুর সোনারবাংলা গড়া সম্ভব হবে।
নাহিদের স্মৃতি রক্ষায় বেশ কিছু সংগঠনের সৃষ্টি হলেও সময়ের আবর্তে অনেক সংগঠনই ঠিক থাকেনি। ২০০৫ সালে আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আমরা শহীদ নাহিদের স্মৃতি রক্ষায় “শহীদ নাহিদ স্মৃতিপরিষদ” গঠন করি। বর্তমানে সংগঠনটি বিয়ানী বাজার থানার চারখাই এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমরা একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেছি। সর্বনিম্ন ফি ট্রাস্টি হবার জন্য আমরা ১০,০০০/= (দশ হাজার টাকা) নির্ধারণ করি এবং ইতিমধ্যে ট্রাস্টি ফি এবং অনুদান বাবত আমরা প্রায় ৩ লক্ষ টাকার মতো ফান্ড সংগ্রহ করেছি। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো নাহিদের স্মৃতি রক্ষায় স্থায়ী ভাবে কিছু করা। আমি আশা করবো নাহিদের স্মৃতি রক্ষায় আপনারা আপনাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবেন যাতে আমরা ভবিষ্যতে স্থায়ী ভাবে কিছু করতে পারি।
লেখক: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী।। প্রিন্সিপাল কেসি সলিসিটর্স, ইউকে। সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সহসভাপতি দি সোসাইটি অব ব্রিটিশ–বাংলাদেশী সলিসিটর্স। তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ইউকে আওয়ামীলীগ।পরিচালক, সেন্টার ফর ব্রিটিশ–বাংলাদেশী পলিসি ডায়লগ। পৃষ্টপোষক শহীদ নাহিদ স্মৃতি পরিষদ, চারখাই।