:ময়নুর রহমান বাবুল:
১৯৭১ সাল । কিশোর বয়সের আমি । স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলার সাত কোটি মানুষের মত আমাদের বাড়ীর মানুষজনও খুব ভয় ভীতি আর সন্ত্রস্ত থাকতেন ।
গ্রামে বাড়ী আমাদের । সহসাই হানাদার বাহিনী এসে আক্রমণ করতে পারবেনা । তবু ভয় সকলকে সব সময় কুরে কুরে খায় আর হন্যে হয়ে তাড়ায় । বাড়ীতে সাত আট ফ্যামিলি বাস করেন । বড় বাড়ী । গ্রামের বাড়ী । বাড়ীতে সব ঘর কক্ষ ইত্যাদি গণনা করতে গেলে শ’ ছাড়িয়ে যাবে । সব পরিবাররে লোক সংখ্যা ছোটবড় মিলিয়ে সর্ব সাকুল্যে পঞ্চাশ ছাড়াবে । কাজের লোক মিলে তা আরও দশ পনেরো ।
তিনটা রেডিও ছিল বাড়ীতে । সন্ধ্যায় ছোট চাচার ঘরে বাবা চাচাগণ জড় হতেন । আকাশবাণী, স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র এবং বি বি সি শোনা হতো ।
রেডিও এর শব্দ কখনো বারান্দা পর্যন্ত যেত না । যখন খবর পড়া হতো তখন ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা । সংবাদ পর্যালোচনা বা কোন কথিকা পাঠ হলেও তাই হতো শুধু স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের দেশাত্মবোধক গান যখন চলতো তখন সবাই মিলে এইমাত্র শুনা খবরগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে পর্যালোচনা সমালোচনা করতেন । তাও খুব আস্তে আস্তে ।
প্রতিদিনই বাইরে উঠোনে বা বাড়ীর পুকুর পারে এক দুইজন কাজের লোক বা চাচা বড়ভাইরা পাহারা দিতেন । বাহিরের কেউ আসে কি না তা তদারকি হতো ।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাগণ আমাদের গ্রামে বা বাড়ীতে সরাসরি দেখেছি কি না আজ মনেনেই । যদিও মাঝে মাঝে গ্রামের যুবকগণ মিলে চাল, ডাল, টাকা চাঁদা উঠাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, এসব স্পষ্ট মনে আছে । তবে যুদ্ধের পর অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষে অথবা ’৭২ এর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি বা তৎপরবর্তী সময়ে কয়েকবারই আমাদের বাড়ীতে অনেকেই আসতে দেখেছি এবং আমার তা স্পষ্ট মনে আছে ।
এসময় বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতার আহমদ আসতেন তাঁর সমমনা সহযোদ্ধাগণ সমন্বয়ে । মুক্তি বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী তথা মুক্তিবাহিনীর অনেকেই আসতেন । আখতার ভাইর সাথে অনেকের মধ্যে সব দিনই ম আ মুক্তাদির অবশ্যই থাকতেন । বাকী সকলের কথা আমার স্মরণে আজ ঝাপশা মনে হলেও মুক্তাদির ভাইয়ের কথা স্পষ্ট মনে আছে । এর কিছু কারণও আছে । তিনি বয়সে সবার ছোট ছিলেন এবং সবাই তাঁকে নামধরে ডাকতেন তাই তাঁর কথা স্পষ্ট মনে পড়ে ।
স্বাধীনতার পর পরই এক গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গে । বাড়ীর মধ্যে, বাড়ীর পিছনে বেশ কয়েকটা গাড়ী । গাড়ীর হেডলাইটের আলোতে বাড়িময় আলোকিত । এগুলো ছিল পিকআপ ভ্যান, জীপ আর মিলিটারি ট্রাক । বাড়ীর সবাই জেগে আছেন । বড় চাচার ঘরে রান্না হচ্ছে ভাত ডাল আর কয়েকটা মুরগী জবাই হয়েছে । আখতার ভাইর সাথে মুক্তাদির ভাই সহ আরো দশ পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধা । ম আ মুক্তাদির ভাইর সাথে এথেকেই পরিচয় ।
মুক্তাদির ভাইয়ের জন্ম ১৯৫২ সালের ১৫ই জুলাই । সিলেট শহরতলীর ‘কদমতলী’ গ্রামে । তাঁর পিতা ছিলেন মুসলিম মিয়া আর মা মর্তুজা বিবি । পাঁচ ভাই, চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম । প্রসঙ্গতঃ এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা উত্তর সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক প্রধান এবং পরবর্তীতে জাসদ নেতা জনাব আখতার আহমদ আমার ফুফুতো ভাই । ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখাপড়ার সুবাদে এবং বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারণে হুলিয়া মাথায় নিয়ে মামাবাড়ী অর্থাৎ আমাদের বাড়ীতেই নিয়মিত থাকতেন । আর সে হিসাবেই স্বাধীনতা উত্তর কালেও তিনি যেতেন এবং অন্যান্যরা সহ মুক্তাদির ভাইও সাথে থাকতেন ।
পরবর্তী কালে ১৯৭৩/৭৪ সালে আমাদের সেই বাড়ীতে নিয়মিত ঘটতে থাকে অন্যসব কাণ্ড । প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এক দুইবার পুলিশের বিরাট বাহিনী অথবা রক্ষীবাহিনীর দল যেতেন আমাদের বাড়ীতে । যেহেতু বাড়ীতে অনেকগুলো ঘর, তাই সব গুলো ঘর এবং সব মানুষকে সার্চ বা তদন্ত করতে হলে অনেক লোকের দরকার । অতএব যতবারই গিয়েছেন রক্ষীবাহিনী বা পুলিশ তার প্রত্যেকবারই অনুমান শতাধিক সদস্য থাকতেন । বাড়ীতে তখন ঘঠে যেত সব হুলস্থূল বিষয় । আখতার আহমদ কোথায় ? অস্ত্র কোথায় রাখা হয়েছে ? এসব তদন্ত । বাড়ীর গরুর ঘর, খড়ের ঘর সব খোঁজা হত । পুকুরে পর্যন্ত খোঁজা হতো । অস্ত্র সব নাকি আখতার আহমদ আমাদের বাড়ীতে লুকিয়ে রেখেছেন । জাসদের কোন এক নেতা বা কর্মী তখন গ্রেপ্তার হওয়ার পরে নাকি একথা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছেন তাই আমাদের বাড়ীতে এসব তদন্ত তাণ্ডব । তাছাড়া তখন জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবে তিনি তখনকার জাসদ সভাপতি মেজর (অবঃ) এম এ জলিলকে নিয়ে আসেন, কুরুয়াতে এবং বালাগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করেন তাই রক্ষীবাহিনীর তৎপরতার আগুনে আরো যেন ঘি দেয়া হয় ।
আমাদের এলাকায় যে কোন রাজনৈতিক তৎপরতায় মুক্তাদির ভাইর উপস্থিতি সব সময়ই ছিল । তাই সবসময়ই তাঁকে দেখতাম । আমরাও উপস্থিত থাকতাম ।
১৯৭৩ সাল । সারা দেশে সংসদ নির্বাচন । আখতার ভাই জাসদ মনোনীত প্রার্থী । অপর পক্ষে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী জেনারেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী । আখতার ভাইয়ের পক্ষে গ্রামে, গঞ্জে, জনসভায়, পথসভায়, প্রচারণায় সবসময় মুক্তাদির ভাই । তিনি তখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শে দীক্ষিত ছাত্রলীগ নেতা । স্মৃতি আমার সাথে বৈরিতা না করলে আমার যতটুকু মনে পড়ে, তিনি তখন মদনমোহন কলেজের ছাত্র।
মুক্তাদির ভাই কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন । কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুক্তাদির ভাই ছিলেন অন্যতম
বেশী মনে পড়ে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতায়, দেশে সাধারণ নির্বাচন হয় । সিলেট- ২ আসনে সংসদ সদস্য পদে জাসদ মনোনীত প্রার্থী আখতার আহমদ তাঁর নির্বাচনী কার্যক্রম কুরুয়া থেকে পরিচালিত হয় সারা বালাগঞ্জ ফেঞ্চুগঞ্জ জুড়ে । এ সময় নির্বাচনী কার্যক্রম উপলক্ষে মুক্তাদির ভাই কুরুয়ায় থাকতেন । এখান থেকেই বিভিন্ন এলাকায় জনসভা পথসভা ইত্যাদি তিনিই করতেন । আমার এক চাচাতো ভাই হারুন । আমার সহপাঠীও সে । কুরুয়া বাজারের নিকটেই তাদের বাড়ী । নির্বাচনী কাজে গভীর রাত হয়ে যেত প্রায়ই । আমরা তখন হারুনদের বাড়ীতে রাত কাটাতাম । কারণ পরের দিন ভোর থেকেই আবার কাজ শুরু করতে হবে তাই দূরে যাওয়া চলবেনা । এসময় হারুনদের ঘরে একটা কক্ষ বরাদ্দ ছিল মুক্তাদির ভাইর জন্য । তিনি মাঝে মধ্যে সিলেট শহরে বা তাঁর বাড়ীতে যেতেন । নতুবা নির্বাচন পর্যন্ত বেশীর ভাগ সময়ই তিনি কুরুয়ায় থাকতেন । তখন আমাদের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক, অবশ্য অগ্রজ অনুজের মতো ।
মূলত মুক্তাদির ভাইকে আমরা এসময় গুলোতেই কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি বেশী । বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত পথসভা ও জনসভাগুলো আয়োজন করার দায়িত্ব ছিল স্ব স্ব এলাকার সমর্থকদের উপর । নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনা করতাম আমরা, অর্থাৎ আমি, হারুন সীতেশদা গং রা । আর প্রথম বক্তা মুক্তাদির ভাই । প্রায় সব সভায়ই বক্তৃতা শুরু করে লোক জড় করতেন মুক্তাদির ভাই । ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা বক্তৃতা । আমরা আশ্চর্য হতাম তাঁর বক্তৃতা আর ধৈর্যে । প্রতিদিনের বক্তৃতার সময়গুলোকে একসাথে যোগ করলে ন্যুনতম চার পাঁচ ঘণ্টা হবে তাঁর বক্তৃতার ব্যাপ্তি কাল । একদিন সকালবেলা কাশি দেন তারপর থুথু ফেলেন । আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই – ভয়ও পাই । রক্ত দেখে আমরা চমকে যাই – কিন্তু তিনি তো স্বাভাবিক । বললেনঃ বক্তৃতা দিতে গিয়ে গলা ফেটে যায় তখন এরকম রক্ত আসে প্রায় সময়ই । চাচী (হারুনের আম্মা) সবসময় আদা কেটে একটা প্যাকেট করে দিতেন – আর স্টেপসীল্স ট্যাবলেট তো মুক্তাদির ভাইর পকেটে আছেই । কিছুক্ষণ পর পর এসব চিবাতেন, চুষতেন । এসময় বক্তৃতায় শুধু ভোট চাইতেন যে তা নয়, অনেক সময় তাত্ত্বিক বিষয়াদিও আলোচনা করতেন, দু একটা হাস্য রসাত্মক কথা ও গল্প বলতেন । এক কথায় মাতিয়ে রাখতেন পুরা জনসভার উপস্থিত জনতাকে । মুক্তাদির ভাইয়ের বক্তৃতার পরেই থাকতেন মকসুদ ইবনে আজিজ লামা । লামা ভাইর বক্তৃতার সময় আমরা কাছে থেকে সরে যেতাম-। সুন্দর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন ঠিকই কিন্তু থুথু ঝরিয়ে আশপাশের সকলের অবস্থা খারাপ করে দিতেন । কিন্তু মুক্তাদির ভাইয়ের তা ছিলনা । নিভৃত গ্রামের বাজারে, যেখানে রিকসা বা গাড়ী যেত না সেখানে ব্যাটারি চালিত মাইক এবং আনুসাঙ্গিক জিনিষ পত্র আমরা কাঁধে হাতে বহন করে নিতাম । অনেক সময় বেশী জরুরী গুলো শুধু নেয়া হত । মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটা প্রায়ই বাদ পড়তো, তখন আমরা বাজারে লাঠি অথবা বাঊ বা ব্যাং (কাঁধে ভার বহনের জন্য বাঁশের নির্মিত বস্তু) এর মধ্যে রশি দিয়ে বা কাপড় রুমাল দিয়ে বেঁধে দিতাম আর তাঁরা বক্তৃতা করতেন
বালাগঞ্জ ফেঞ্চুগঞ্জ সহ এসব নির্বাচনী সভা ছাড়া অন্যান্য সময়ও জাসদ বা ছাত্রলীগের কর্মী সভা, সম্মেলন ইত্যাদিতেও মুক্তাদির ভাই কুরুয়া বা অন্যান্য এলাকায় আসতেন সাংগঠনিক এসব কার্যক্রমে অংশ নিতেন । বক্তৃতা করতেন ।
এসময়টায় তাঁকে দেখেছি নির্লোভ, নিরহঙ্কারী এবং অতি সাধারণ চলাফেরা করতে । খাবার দাবারে অতি সাদামাটা ছিল তাঁর ব্যবস্থা । যে কোন একটা হলেই চলবে ।
দীর্ঘ দিনের ব্যবধান । কিন্তু আজও একটু ধ্যান করলেই আমি যেন শুনতে পাই মুক্তাদির ভাইর সেই চির চেনা সম্বোধন টা ‘কিতারেবো বাবুল’ । আখতার ভাইয়ের আত্মীয় এজন্যে নয়, আমাকে, হারুন সহ আরো অনেককেই তিনি খুব স্নেহ করতেন ।
আসলে তিনি সকলকেই এরকম স্নেহ দিয়ে উৎসাহ দিয়ে কাজে মগ্ন রাখতে পারতেন । কিছু কিছু অদ্ভুত এবং অতুলনীয় গুণাবলী ছিল মুক্তাদির ভাইয়ের মধ্যে যা সচরাচর অনেকেরই থাকেনা ।
১৯৭৯-৮০ তে আমি সরকারী এম সি কলেজে ভর্তি হই । মূলত তখন থেকেই আমি সক্রিয় ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে যাই । সেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় শপথ । বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ।
সে সময় তিনি সম্ভবত ঢাকা থাকতেন । আমার মনে পড়ে ছাত্রলীগ সম্মেলনে বা সগঠনের অন্য কোন সাংগঠনিক অনুষ্ঠানে ঢাকা গেলে তিনিই আমাদের দেখা শুনা করতেন – অবশ্য সে সময় তখনকার ছাত্রনেতা শাহ্ মোহাম্মদ আনসার আলী, লোকমান আহমদ এবং জাকির হোসেন নাণ্ণূ গং সিনিয়র বা বয়োজ্যেষ্ঠগন আমাদের তত্ত্বাবধান করতেন।
যদিও পরবর্তী কালে সবার সাথেই মত ও পথের অমিল হয়, সাংগঠনিক কার্যক্রম হয় ভিন্ন ধারার । শাহ্ মোহাম্মদ আনসার আলীর সাথে মুক্তা দির ভাইয়ের কিছু ক্ষেত্রে মিল লক্ষণীয় । দুজনই সাদাসিধে জীবন ধারণ করতেন । আনসার ভাই পরবর্তীতে জীবনের তাগিদে সৌদিআরব চলে যান এবং সেখানে পরবর্তীতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন । আর মুক্তাদির ভাই প্রধানত সেই একই কারণেই যুক্তরাজ্য চলে আসেন এবং…………।
এম সি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৪ সালে । আনসার ভাই ছাত্র সংসদের ভি পি, নির্বাচিত হন । এর পর দীর্ঘ মধ্য বিরতির পর ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন । সে নির্বাচনে আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই আমাদের পুরো প্যানেল সহ । নির্বাচনের পরে আখতার ভাই আমাকে তাঁর রায়নগর বাসায় দাওয়াত করেন । যথাসময়ে আমি গিয়ে দেখি মুক্তাদির ভাইও সেখানে । তাঁরা দুজনই খুব খুশী এটা বুঝতে পারি, – মনে হল তাঁরা যেন খুব গর্বিত বোধ করছেন ।
সম্ভবত এবছরই সিলেট জেলা ছাত্রলীগ সম্মেলনে মুক্তাদির ভাইয়ের সাথে আমাদের একটু ব্যবধান এবং দূরত্ব সৃষ্টি হয় । এবং তখনই বা তার কিছু পরেই জাতীয় রাজনীতিতে ভাঙ্গন ধরে এবং স্বাভাবিক ভাবেই তখন ছাত্রলীগ ও বিভক্ত হয় । মুক্তাদির ভাই সহ অনেকে বাসদ অংশে চলে যান । আমরা এদিকেই থাকায় রাজনীতিতে দূরত্বটা বেশী হয়ে যায় ।
আমাদের এই দূরত্বটা আরো দীর্ঘায়ীত হলো । ১৯৮৬ সালে তিনি দেশ ছেড়ে চলে আসেন যুক্তরাজ্যে । আমি মতপরিবর্তন করি । রাজনীতিতে বাম থেকে এবার সর্ব বামে চলে যাই । যে স্বৈরাচারের রোষানলে পড়ে হুলিয়া মাথায় নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের লড়াকু সৈনিক ম আ মুক্তাদির নিজের দেশ ছেড়ে চলে আসেন । সেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে আমি বন্দী হই কারাগারে । দীর্ঘ কারাবরণ শেষে মুক্ত হই ঠিকই কিন্তু তার কিছুদিন পরেই আমি মুক্তাদির ভাইয়ের পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হই । ১৯৯২ সালে আমিও যুক্তরাজ্য প্রবাসী হলাম । যে দেশের জন্য কৈশোরেই স্কুল কলেজের বই খাতা রেখে মুক্তাদির ভাই তুলে নিয়ে ছিলেন অস্ত্র, সেই দেশে তাঁর জন্য চারিদিকে যখন বায়ু দুষিত হয়ে উঠে তখন তিনি বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়েন এবং এখানে এসে জীবনের অন্যরকম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন ।
আমি আসি ১৯৯২ সালে লন্ডনে । ব্রিকলেনে আবদুস সালিক ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে দেখা হয় মুক্তাদির ভাইয়ের সাথে । কিন্তু আজকের সম্বোধন একটু ভিন্নঃ ‘কিতা রেবো কমরেড’ ? কোশলাদি এবং অনেকক্ষণ ধরে হ্যান্ডসেক আর বুকে জড়িয়ে ধরেন আমাকে । তারপর আমরা অনেকক্ষণ ধরে সালিক ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট এ বসে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা এবং তখন তিনি আমাদের বাড়ীর এবং কুরুয়ার অনেকের কথাই জিজ্ঞাস করেন । সালিক ভাইয়ের কয়েক কাপ চায়ের শ্রাদ্ধ হয় তখন । সেদিন আমার দৃষ্টিতে নতুন এক মুক্তাদির ভাই আবিষ্কৃত হলেন । আমি তাঁর আচার আচরণে খোঁজে পেলাম অতৃপ্তি ! হতাশা । কোথায় যেন তাঁর অনেক হাহাকার । বেদনা । এটা স্পষ্টত আমি বুঝতে পারি, অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করি তাঁর শূন্য বুকের হাহাকার । না; দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তিনি কিছু পেলেন না – সেজন্য নয় । না; অনেক ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন দেশে সাম্যের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়নি, সর্বহারা এবং শ্রমিক শ্রেণীর শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়নি এজন্যেও যেন নয় – অন্য কোন কারণে অন্য কোন যন্ত্রণায়
এরপর প্রায়ই এখানে ওখানে দেখা হয়েছে । কথা হয়েছে । পূর্ব লন্ডনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রায় সব অনুষ্ঠানেই দেখা হতো মুক্তাদির ভাইয়ের সাথে । নতুন দিন পত্রিকার অফিসে দেখা হতো । তাসাদদুক আহমদ সাহেবের ঠিকানা তিনিই প্রথম আমাকে দিয়ে ছিলেন ।
সম্ভবত ১৯৯২ সালের অক্টোবর বা নভেম্বর মাস হবে । ভোর বেলা চূণ্ণূ ভাই লিপি ভাবীর বাসায় আমি কোন এক জরুরী কাজে । চা নাস্তা হচ্ছে এমন সময় মুক্তাদির ভাইও উপস্থিত সেখানে । আমার সে জরুরী বিষয়ে মুক্তাদির ভাইও সহযোগিতা করেন । তারপর একটা চিঠি ডাকে ছাড়ার জন্য তিনিই আমাকে কাছের একটা ডাকঘরে নিয়ে যান । আজও পিলপোট লেন পোষ্ট অফিসে গেলে আমার সবসময় মুক্তাদির ভাইয়ের কথা মনে পড়ে ।
এদেশে আসার পর থেকে সদা কর্ম চঞ্চল মুক্তাদির ভাই কখনো বদ্ধ জলাশয়ের মতো বসে থাকেন নি । বহমান নদীর মত তাঁর কলতান, তাঁর প্রবাহ সদা প্রবাহমান ছিল । পিছন ফিরে তাকান নি তিনি । জীবনে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও হতাশায় ভেঙ্গে যাননি । নিজের আদর্শ থেকে শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বিচ্যুত হননি । স্বীকার করবো যে মুক্তাদির ভাই জাতীয় কোন নেতা ছিলেন না ঠিকই কিন্তু যা-ই ছিলেন, একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমাদের কাছে তিনি নমস্যঃ তিনি পূজ্যঃ তিনি উদাহরণস্বরূপ ।
যুক্তরাজ্যে আসার পর থেকেই স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে কমিউনিটির উন্নয়নে নিরলস কাজ করে গেছেন । স্বভাব সুলভ ভাবেই মগ্ন থেকেছেন স্বজাতির কল্যাণ ও উন্নয়ন মূলক কাজে । তিনি বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন সব সময় । স্থানীয় লেবার পার্টিতে একনিষ্ঠ একজন কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন । প্রবাসীদের দাবী দাওয়া সম্পর্কিত সকল আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী দালাল চক্রকে তিনি মোটেও সহ্য করতে পারতেন না কখনও । যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে অনড় এবং এব্যাপারে তাঁর কর্মতৎপরতায় তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন ।
১৯৯৪ সালে চ্যানেল ফোর টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ড্যাশপাচ অনুষ্ঠান । ওয়ারক্রাইম ফাইল । মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা, দালালী এবং সরাসরি জড়িত যুদ্ধাপরাধী তিনজনের উপর একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর পর ব্রিটেনে ও বহিরবিশ্বে অবস্থানরত প্রবাসী সচেতন নাগরিকগণ ফুঁসে উঠে । এরা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে লন্ডনেও প্রচুর সভা সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রদান সহ সকল কর্মতৎপরতায় মুক্তাদির ভাইয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো । মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের সাথে তিনি সক্রিয় কাজ করেন ।
বাঙালী অধ্যুষিত ব্রিকলেনকে বাংলা টাউন ঘোষণা দেয়ার দাবী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ হয় পূর্ব লন্ডন জুড়ে । অবশেষে কর্তৃপক্ষ ১৯৯৭ সালে ঘোষণা করে ব্রিকলেনকে বাংলা টাউন হিসাবে । উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জননেতা আবদুস সামাদ আজাদ । আর মুক্তাদির ভাই এ অনুষ্ঠানের একজন আয়োজক । আর এই নিবেদিতপ্রাণ আয়োজক তার আয়োজন করতে করতে অবশেষে নিজের অজান্তেই নিজের শেষ আয়োজনের দিকে এগিয়ে যান । ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে এই প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, অমায়িক মুক্তাদির ভাইয়ের হৃদ স্পন্দন চিরকালের জন্য বিশ্রাম নেয় – প্রকৃতির এই ইচ্ছাটুকু খুবই কার্পণ্যের এবং চরম নিষ্ঠুরতার হলেও মেনে নিতে হলো, মেনে নিলাম – এইতো নিয়ম । বাগানে ফুল ফুটে গন্ধ বিলায় এবং ক্রমান্বয়ে পরিণতির দিকেই যায় । প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়মে সবই চলে – মানুষও । কিন্তু কাননে ফুল যদি মুকুলেই ঝরে যায় তখন নিষ্ঠুর এই বিয়োগ প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম । কিন্তু মাত্র ৪৪ বছর বয়সে এ নিয়মের প্রয়োগটা যেন কিছুটা কার্পণ্যের হয়েগেল । এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার দামাল ছেলেরা ছিনিয়ে আনে দেশের স্বাধীনতা । ম আ মুক্তাদির সেই বীর ছেলেদের একজন, যিনি যুগের এই নিষ্ঠুর বন্ধন হতে নিজেকে গুটিয়ে নেন । প্রজন্মকে ইঙ্গিত দিয়ে যান, উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যান সত্যের কথা, সুন্দরের কথা, আদর্শের কথা ।
{ময়নূর রহমান বাবুল – প্রকাশিত গ্রন্থঃ ”চোখের দেখা প্রাণের কথা” ১৩৩ পৃষ্ঠা }
লেখক ময়নুর রহমান বাবুল
বিলেতের প্রধানতম কবিদের একজন একসময় প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং নেতৃত্ব দেন ৷
ACB17@